চাঁদের ছায়া এ-পিঠ ও-পিঠ


অতঃপর নেমে আসে চাঁদ কেওয়াছড়ার মাঠে। সেখানে কুয়াশা জমে বিন্দু বিন্দু, আলোতে চিকিমিকি করে সবুজ চাদর। ছায়াবৃক্ষ পরস্পরে প্রেম বিলায় আর বাতাসে ডানা ঝাপটায় একাকী পেঁচা। আরেকটা নাম না জানা পাখি উড়ে যায় মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিরিষ ছেড়ে, সুভাষ সচেতন হয়, একটা বাজলো। কাঠালের নিচু ডালে বাঁধা প্রাচীন ঘণ্টায় আলতো ছোঁয়ায় হাতুড়ি, ঢঙ... রাত একটা বাজলো।

সুমনা আস্তে আস্তে নিজেরে ছাড়িয়ে নেয়, শ ...অতঃপর নেমে আসে চাঁদ কেওয়াছড়ার মাঠে। সেখানে কুয়াশা জমে বিন্দু বিন্দু, আলোতে চিকিমিকি করে সবুজ চাদর। ছায়াবৃক্ষ পরস্পরে প্রেম বিলায় আর বাতাসে ডানা ঝাপটায় একাকী পেঁচা। আরেকটা নাম না জানা পাখি উড়ে যায় মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিরিষ ছেড়ে, সুভাষ সচেতন হয়, একটা বাজলো। কাঠালের নিচু ডালে বাঁধা প্রাচীন ঘণ্টায় আলতো ছোঁয়ায় হাতুড়ি, ঢঙ... রাত একটা বাজলো।

সুমনা আস্তে আস্তে নিজেরে ছাড়িয়ে নেয়, শফিকুলের হাতটা এতক্ষণ তার পেটে চেপে ছিলো। শ্রান্ত হাত সরানোর সময় হয়নি, কখন ঘুমিয়েছে নিজেই টের পায়নি। সুমনাও ইচ্ছে করেই হাতটা সরায়নি। ঘুমোতে দিয়েছে। এখন যখন সুভাষের ঘণ্টায় বেজেছে একটা, তখন নিজেরে সে মুক্ত করে। বিছানার কার্নিসে বসে কিছুক্ষণ, না, শফিকুল ঘুমুচ্ছে। ও আর জাগবে না যতক্ষণ না সুভাষ ঘন্টায় ছয়বার হাতুড়ি পেটাবে। ততক্ষণ সুমনার ছুটি, ইচ্ছেমতো কাটাবার মতো এইটুকুনই সময়।

অক্টোবরের শেষেই এখানে অনেক ঠাণ্ডা পড়ে। কুয়াশার স্তরগুলো অনেক গাঢ়। বাগানবিলাসে সাজানো সদরের দরজাটা ঝাপসা দেখায়। ব্রিটিশ আমলের সাজানো বাংলো, সামনে এক মাপে ছেটে রাখা ঘাসের উঠোন। সুমনা নেমে আসে উঠোনে, কুয়াশায় জবুথবু দুর্বা ঘাস, পায়ে শিরশিরে ঠান্ডা লাগে, ডালিয়ার গাছটা বড় হচ্ছে, হালকা সবুজ পাতা এখন এই চাঁদের আলোতে কেমন ফ্যাকাশে দেখায়। উঠোনের এককোনে রাখা দোলনাটা দুলছে, মিহি বাতাসে দুলছে। সুমনা আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়, দুচালা ছোট্ট চালের নিচে সাদা রঙের দোলনা, দোল খেতে খেতে খেতে কোন সুদূরে হারায় সে।

স্কুল থেকে বাড়িটা কাছেই ছিলো। মাঝখানে একটা ছোট্ট পার্ক। সেই পার্ক রড দিয়ে ঘেরা। স্কুলের দিকের একটা রড কে যেনো ভেঙ্গে রেখেছিলো। সেই ফাঁক গলে অনায়াসে ঢুকে পড়তো সুমনা। তারপর তেরছা দৌড়ে পার্কের গেট পেরিয়ে বাড়ির সীমানা। একদিন অতি পরিচিত সেই ফাঁকায় কীভাবে যে আটকে গেলো সে, হাতের কাছে সাদা জামাটা ছিড়ে গেলো। এক হাতে সেটা ধরে আস্তে আস্তে ফিরে এলো বাড়ি। সেদিন পা'টা স্বতঃস্ফুর্ত ছিলো না। না ভয়, না লজ্জা, অন্য কী এক অনুভব ছিলো তার। পরিচিত রাস্তাটা বুঝি আজ থেকে বন্ধ হলো। বাড়িতে ঢুকতেই মা ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এলো। কিরে কী হয়েছে, উত্তর দেয়ার আগেই আবার বলে, যা দৌড়ে ঘরে যা, জামাটা বদলে নে। একটা শাড়ি পর। সে ভেবেছিলো জামার ছেড়াটা বুঝি মা দেখতে পেয়েছে। কিন্তু শাড়ি পরতে বলল কেনো? সাত-পাচ ভাবতে ভাবতে সে সত্যি সত্যি শাড়ি পরে ফেলে। তারপর আর ভাবনার সময় কোথায়? সাত দিনের মাথায় বিয়ে, তার দশ দিন পর এই নির্জনবাস।

প্রথম প্রথম মিশ্র এক অনুভূতি ছিলো। সারি সারি নির্জনতাটা সেভাবে বুঝতে পারতো না, আবার কখনো সখনো বড় তীব্র একা মনে হতো নিজেরে। সকালে একটু বেলা করে শফিকুল বেরিয়ে যেতো কাজে। ফিরেও আসতো বিকেল থাকতে থাকতে। নির্জনে রাত একটু আগেই আসে বুঝিবা। ভালোবাসার রকমফের তখনও করতে শেখেনি সুমনা, শুধু মনে হতো শফিকুল তারে বড়ো বেশি ভালোবাসে। মানবিক কিংবা পাশবিকের কোন পার্থক্য ছিলো না তার। নিজেও মেতে উঠতো মৌনতায়, যৌনতায়। এখন কেবলি মৌনতা টিকে আছে। মাঝে মাঝে মনে হয় মৌনতাও নাই আর, সে কেবলই একখণ্ড মাংস।

শফিকুল এখন সকালে বেরোয়। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়, সন্ধ্যার আগেতো কখনই না। যেদিন সন্ধ্যায় আসে, সেদিন আবার বেরিয়ে যায় ক্লাবে। আর কোনো কোনো দিন ক্লাব ট্লাব সেরে তারপর আসে। নিয়মের মানুষ, সময় মেনে খাবে, অল্পক্ষণ টিভি দেখবে, তারপর বিছানায় যাবে, রোজ রোজ একইভাবে সুমনাকে কাছে টেনে নেবে, পরিশ্রান্ত হয়ে একইভাবে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়বে। নতুন কিছু নেই। কারখানায় বড় ঘন্টা আছে, সুভাষ সেখানে ঢং ঢং করে হাতুড়ি পেটাবে, সাড়ে ন'টায় বাড়ি ফেরা, দশটায় খাবার, তারপর টিভি, সাড়ে এগারোতে বিছানা, বারোটায় পাশ ফিরে শোয়া... এইতো।

এ বাড়িতে আসার পর, মাসখানেক কেটে গেলে কিছুটা ধাতস্থ হচ্ছে যখন, তখন একবার শফিকুলকে জিজ্ঞেস করেছিলো, সারাদিন সে কী করবে? শফিকুল অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বলেছিলো,কী করবে মানে? মেয়েরা ঘরে থেকে কী করে? সবাই যা করে তুমিও তাই করবে। কথা বাড়ানোর স্বভাব কখনই নেই ওর। তাই আর কথা বলেনি। কিন্তু কী করার আছে তার? সকালে রতন আসে পুরো বাড়ি ঝাড় দিতে, তার একটু পরে আসে শান্তিময়, বাগান করা তার দায়িত্বে, চন্দ্রনাথ আসে এদেরও আগে, একেবারে অন্ধকার থাকতে থাকতে সে হাজির হয়। সকালের খাবার তৈরি তার কাজ। সবকিছুই আসলে রুটিন বাঁধা। মা খালারা যেভাবে নিজেদের ব্যস্ত রাখেন সুমনার সেরকম কিছু হয় না। তবু সে মানিয়ে নেয়। শান্তিময় নিজের মতো করে যে বাগান সাজাচ্ছিল এতকাল, সেখানে টুপ করে ঢুকে পড়ে সুমনা। বারান্দায় বসে বসে অনুচ্চকণ্ঠে সে শান্তিময়কে এটা সেটা বলে, খুব দরকার হলে নিজেই নেমে যায়, তখন মনমোহিনী ছাতা ধরে রাখে তার মাথায়। শফিকুলের অনেক খেয়াল, গায়ের রংটা যাতে এতটুকু ময়লা নাহয়, সেজন্য নিয়ম করে তাকে হলুদ মাখতে হয়। একেবারে প্রথম রাতেই পেটে হাত বুলাতে বুলাতে শফিকুল বলেছিলো, এখানে মাংসের দলা তৈরি করোনা কখনো লক্ষ্মীটি, তারপর শরীরের ইতি উতি নানান ভূমিতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলেছিলো প্লিজ... প্লিজ...প্লিজ... সুমনা সেসব ভুলেনি, ভুলবে না। তাই এখনও সন্তানবতী সুমনা সেই আগের মতোনই সমান প্রিয়দর্শিনী।

আজকের চাঁদের বয়েস কতো? পূর্ণিমার আগে পরে এখানে চাঁদ এতো বেশি কাছে আসে যে বয়েসটা ঠিক ধরা যায় না, অথবা সুমনা সেসবের হিসাব রাখতে পারে না। এ বাড়ির প্রথম রাতটাই ছিলো চাঁদ রাত। বিকেলের দিকে ওরা এসে পৌঁছেছিলো। শরীরটা জুড়িয়ে নিতে না নিতেই নেমে এলো অন্ধকার, আর একটু পরেই ঝুপ করে জেগে উঠলো আস্ত একটা চাঁদ। বারান্দায় বসে বসে দুজনে চা খচ্ছিলো তারা। এমন পাগল করা জোৎস্না দেখে সুমনা বসে থাকতে পারেনি। ছুটে এসেছিলো উঠোনে। দুহাত দু দিকে ছড়িয়ে দিয়ে কয়েকটা পাক খেলো সে, তার মনে হচ্ছিল চাদেঁর আলো বুঝিবা তারে ছুঁয়ে দিলো। শফিকুলও নেমে এসেছিলো একটু পরে, স্ত্রীর পাশে দাড়ালো কিছুক্ষণ, তারপর খুব আস্তে আস্তে সাবধানে বল্লো/বলল, একবার পেছনে তাকাও, দেখো দরজায় দাড়িয়ে আছে বাবুর্চি, আয়া, এদের সামনে এভাবে চলতে নেই। একটানা বাজতে থাকা রবীন্দ্রনাথের গান যেভাবে লোডশেডিং এ বন্ধ হয়ে যায়, সেভাবেই যেনো থেমে গিয়েছিলো সুমনা। তারপর কত চাঁদ নেমে আসে এই বনজ বৈভবে সুমনা তার খোঁজও রাখে না।

রাত বাড়ছে, কুয়াশা পড়ছে আরো ঘন হয়ে। রাতের কি আলাদা কোন ভাষা আছে? সেই ভাষা পড়া যায়? যায় বোধহয়। সুমনার সেসবে কোন আগ্রহ নেই। সে শুধু জানে, এই নির্জনের মাঝে আরো নির্জনতা আসে রাতের আঁধারে। সেই আঁধারে নিজেরে খুলে দেয়া যায় ইচ্ছেমতো, কেউ দেখবে না, খাবলে খাবে না। শুধু ছুঁয়ে দেবে, কোমল সে ছোঁয়া। সুমনা আলতো পায় হেঁটে যায়, বাংলোর পেছনে টলটলে পানির একটা পুকুর আছে, তার শানবাধানো ঘাটে বসবে বলে। এখানকার সবকিছুই গোছানো, ছবির মতো, নাটকের পাণ্ডুলিপির মতো। তবু রাতের এই সময়টাতে সবকিছুই অন্যরকম মনে হয়। অভ্যস্থ পায়ে সুমনা এগিয়ে যায়।

পুকুরে একসময় প্রচুর কচুরিপানা ছিলো। বছরখানেক আগে সেসব পরিস্কার করে মাছ ছাড়া হয়েছে, আফ্রিকান মাগুর। সুমনা চাইছিলো দেশী মাছ ছাড়তে, আর পুকুরের ঠিক মাঝখানে থাকবে শাপলা। কিন্তু শফিকুল সেসব হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। আফ্রিকান মাগুর দ্রুত বাড়ে, বিশাল সাইজের হয় একেকটা, আর খাবার দাবারও দিতে হয় না তেমন। ঘাটের পাশে একটা গামলা রাখা। রাতে মোরগ জবাই করা হয়েছে, সেটার নাড়িভুড়ি, ডানা, ঠ্যাং এসব রাখা হয়েছে। সকালে এসেই চন্দ্রনাথের প্রথম কাজ এগুলো ছুঁড়ে দেয়া। ঘাটে বসতেই মাছগুলো যেনো তার ঘ্রাণ পেয়ে যায়। শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে ভাসতে থাকে ঘাটের আশেপাশে। সুমনা উঠে দাঁড়ায়। গামলাটা হাতে নেয়। চারটা মোরগের নাড়িভুড়ি, বেশ ভারী। দুহাতে ধরে গামলা উচিয়ে ছুঁড়ে মারে, ঝুপ করে নাড়িভুড়িগুলো পানিতে পড়ে। প্রচন্ড আলোড়ন তৈরি হয় পুকুরে। পুকুরের চারপাশ থেকে মাছগুলো ছুটে আসে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। উচ্ছিষ্টগুলো ছিঁড়ে ফেলছে যেনো, মনে হচ্ছে নিজেদেরই মাংস খেয়ে ফেলবে।চাঁদের আলোয় চিক চিক করে উঠে জলের উপর ভেসে উঠা কালো কালো চামড়া। কী বিশ্রি কামড়াকামড়ি। দেখতে দেখতে সুমনার মাথাটা কেমন আউলে যায়, কয়েক ঘণ্টা আগের নিজেকেই যেনো দেখতে পায় পুকুরে... সুমনা ভাসছে... সুমনা ডুবছে... তাকে খাবলে খাচ্ছে কালো কালো হাত, নখর, দাঁত...


(এই শিরোনামে আবুল হাসান এর একটা কবিতা আছে)

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা