লজ্জা

প্রশ্ন কমে যাচ্ছে এখন। আগে যেমন প্রতিটা ঘটনায় হাজারটা প্রশ্ন শুনতে হতো এখন সেরকম না। একটা দুটা প্রশ্ন, তার সাথে মানানসই উত্তরেই কাজ হয়ে যায়। বলছিলাম আমার ছেলের কথা। বড় হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারি। নিজেই উত্তর খোঁজতে শিখে যাচ্ছে।
লাল মোটর সাইকেলটা সড়কের ঠিক মাঝ বরাবর পড়ে থাকতে দেখে সে প্রশ্ন করে, বাবা এটা এভাবে পড়ে আছে কেনো, পাশের মেকানিকের দোকানটা দেখিয়ে বলি, ওরা মনেহয় ফেলে রেখেছে। আগে এভাবে বল্লে পাল্টা প্রশ্ন হতো, রাস্তায় কেনো? এখন সেটা হয় না। মোটর সাইকেলটা পাশ কাটিয়ে আসার সময় পিচে পড়ে থাকা রক্তের ছোপটা তার চোখ এড়িয়ে যাবে সেটা আশা করি না। ওর চোখ এখনও অনেক প্রখর। কিন্তু তবু কথা বাড়ায় না। এর আগে আরেকদিন, ছোট জটলাটা পার হবার সময়, অন্ধকারে ওর চোখে পড়ে হাতে থাকা কিছু একটাতে। আমি অবলীলায় বলে দেই, এটা হকি খেলার ব্যাট। দু’দিন পর ও ঠিকই গল্প বলে তার মায়ের কাছে, বাবা বুঝতে পারেনি ওটা লম্বা লম্বা দা ছিলো, সে এগুলোরে হকির ব্যাট মনে করেছে... আমি একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ি, যাক ছেলে বোকা ভেবেছে, মিথ্যুকতো আর বলেনি।
বাড়িতে খবর শুনিনা, খবরের চ্যানেল থেকে দুরে থাকি। কাবাব হয়ে যাওয়া মানুষ, কব্জি উড়ে যাওয়া হাত কিংবা বারবিকিউ চুলা বনে যাওয়া বাসের খবর শুনলে যেসব প্রশ্ন শুনবো সেটার কোন উত্তর আমার কাছে নেই। তবু সেসব খবর আড়াল করতে পারি না। আগে পত্রিকার পাতার ছবি দেখিয়ে নিচে কি লেখা আছে সেটা জেনে নিতো, এখন নিজেই বানান করে করে পড়ে নেয়। কঠিন শব্দ দেখলে সেটার উত্তর মাঝে মাঝে জানতে চায়, তখন বুঝি ছেলে আমার বড় হচ্ছে, তখন বুঝি ছেলে বড় হচ্ছে এক অরাজক সময়ে।
৮৭ নভেম্বরে আমার যে বয়েস ছিলো তার চে বছর খানেকের ছোট আমার ছেলে। সেবছর আমি মিছিলে ছিলাম, সেই মিছিল থেকে আমাদের বের করে দেয়া হয়েছিলো, তারপরও হেমিলনের শিশুদের মতো আমরা অনেকে সেই মিছিলের পেছন পেছন হেটেছি কালনী পারের ছোট্ট শহরে। নূর হুসেন যেদিন শহীদ হলেন সেদিন বিকালে মুখস্থ হওয়া স্লোগান জপতে জপতে আনমনে ঢুকে গেছি খেলার মাঠে। বেডমিন্টনের র‍্যাকেট লেগে মাথা ফেটে গেছে, যারা মিছিল থেকে বের করে দিয়েছিলো তারা দেখতে এসে বলেছে, দেখেছো, বাচ্চাদের মিছিল দিতে নেই। মিছিল দিলে মাথা ফাটে... আর এখন শিশুদের হাতে রামদা তুলে দেওয়া হয়। সেই ছবি আসে পত্রিকার পাতায়, আমার ছেলে সেই ছবি দেখিয়ে বলে, বাবা এদের হাতে এতো বড়ো দা কেনো? আমি মিথ্যা বলি আবার, গরু জবাই করবে বলে দিয়েছে মনে হয়...
রোজ স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে নয়তো এম্নিতেই বেরুলে আমাকে এখন গাদা গাদা মিথ্যা বলতে হয়। মাঝে মাঝে কর্কশ কণ্ঠে ধমক দেই, কেনো এতো প্রশ্ন করে! অথচ তাকে প্রশ্ন করা শিখিয়েছি আমি। কিছুদিন আগেও প্রশ্ন শুনে আহ্লাদিত হয়েছি, আর এখন সবচেয়ে বেশি ভয় পাই সেই প্রশ্নকেই। মাঝে মাঝে বলি, দুষ্টু লোকের কাজ, তখন আবার উল্টা প্রশ্ন, এদেরকে পুলিশ ধরেনা কেনো... মিথ্যার পিঠে মিথ্যা বাড়তেই থাকে।
আর মাত্র কটা মাস/বছর। এরপর এই ছেলেটা সব বুঝে যাবে, সে জেনে যাবে তার বাবা কত মিথ্যা বলেছে তাকে, জেনে যাবে এক ভয়ঙ্কর মিথ্যার মাঝে তাকে বড় করেছে তার মা! সেই বুঝতে পারার দিনটার মতো লজ্জার দিন আর হতে পারে না। লজ্জা... লজ্জা... লজ্জা...

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা