শিরোনামের সঙ'বাদ, সংবাদের শিরোনাম

সিলেটে একসময় বন্দরবাজারে গেলে আজব কিছু পত্রিকা পাওয়া যেতো। মাঝে মাঝে সেসব পত্রিকা মাইক দিয়ে ডেকে ডেকেও বিক্রি হতো। সম্ভবত দেশের অন্য অঞ্চলেও এটা হতো। কারণ পত্রিকাগুলো ঢাকা থেকে বের হতো। বিচিত্রসব খবর, তারচেয়ে অধিক বিচিত্র শিরোনাম ছিলো সেসবের। যেমন একদিন প্রধান শিরোনাম ছিলো 'অবৈধ সন্তানের মা হতে চলেছেন খালেদা'! সেটা আবার মাইকে বলা হচ্ছে, একেবারে গাজী মাজহারুল আনোয়ার স্টাইলে। আমাদের বদর মামা বিরাট রসিক লোক। সারাদিন টো টো করে সিলেট শহর ঘুরে বেড়ান। পায়ে হেঁটে। তিনি একটা পত্রিকা কিনলেন। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সেটা নিয়ে হুলস্থুল। যতরকমভাবে মজা করা যায় সেটা করে তারপর জানা গেলো কোন এক প্রান্তিক জনপদের খালেদা নামের এক তরুণী, প্রেম করেছিলেন। এখন মা হবেন, কিন্তু প্রেমিক সটকে পড়েছে। তখন ধর্ষিতা বা নির্যাতিতার নাম প্রকাশে নিষেধ ছিলো না। তাই নাম দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বিষয় সেটা নয়, বিষয় হচ্ছে 'খালেদা' নামটি। খালেদা জিয়া দেশের প্রধানমন্ত্রী। মাত্রই তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন। সাধারণ মানুষের ব্যাপক আগ্রহ তাকে নিয়ে। বিশেষ করে গ্রামের মানুষ, যাদের কাছে দেশের শাসক হিসাবে নারী বিষয়টাই অদ্ভুত। তো সেই মানুষরা হঠাৎ শুনলেন খালেদা মা হচ্ছেন! তারা জানেন খালেদা নামের মানুষটা দেশের শাসক, তার স্বামী নেই, তিনি কেমন করে মা হতে পারেন! এই কৌতুহলকে কাজে লাগাতেই এমন শিরোনাম! আমি কল্পনায় দেখতে পাই, গ্রাম থেকে চাল কুমড়া বিক্রি করতে আসা পড়ালেখা না জানা মানুষটা ব্যাপক কৌতুহলে কিনে নিলেন পত্রিকাটা। সন্ধ্যার অন্ধকারে গ্রামে ঢুকেই বাড়িতে না গিয়ে ছুটে গেছেন ছোট্ট মুদি দোকানে। সেখানে পরিচিত দোকানী প্রদীপের আলোয় সেই পত্রিকা পড়ে জানাচ্ছেন সেই নাম না জানা খালেদার খবর, যার সাথে রাস্ট্র ক্ষমতার দুরতম কোন সম্পর্কও নাই।
এইযে ঘটনা, এটাকে কী বলা হবে? আমার হিসাবে বাটপারি। সাংবাদিকতার হিসাবে অপ-সাংবাদিকতা। মানুষকে বিভ্রান্ত করে, চটকদার খবর, শিরোনাম তৈরির এই প্রবনতাটাই সাংবাদিকতার দুর্বৃত্তায়ন, যা চলে আসছে দীর্ঘকাল থেকে।
এই অশালীন চর্চ্চা চলছে যুগে যুগে। সম্ভবত এই ২৪ বা ৪২০ এর জামানায় এই প্রবণতার বিস্ফোরণ ঘটেছে। একদম প্রথমে যে পত্রিকার কথা বল্লাম, সেটির একটি পরিচিত চরিত্র ছিলো। পত্রিকার বেশিরভাগ পাঠক সেটা জানতেন, বুঝতেন। তাই অনেকেই এড়িয়ে যেতেন। কিন্তু এখন সেটা কেমন করে এড়ানো যাবে? এখনতো আর চিহ্নিত সেইসব পত্রিকাই শুধু নয়, প্রতিষ্ঠিত মূলধারার দৈনিক, বিশ্বাসযোগ্য ওয়েব দৈনিকও সেখানে যোগ দিয়েছে।
এখন এরা খবরের সাথে দুরতম সম্পর্ক খোঁজে বের করে তৈরি করে শিরোনাম, সেই অদ্ভুত শিরোনামে বলা হয় মন্ত্রীর মৃত স্বামীর ভাগনা আত্মহত্যা করছেন! আত্মহত্যা একটি খবর, সেটি প্রকাশিত হবে, যে আত্মহত্যা করলো তার পরিচয়ও আসতে পারে, সেখানে হয়ত এটাও আসতে পারে যে, আত্মহত্যাকারী মন্ত্রীর আত্মীয়। কিন্তু সেটাকে একেবারে শিরোনামে নিয়ে যাওয়া এটা কেমন ধারা?
আজকেরই একটা শিরোনাম, ঘুমের ঔষধ খেয়ে আঁখি আলমগীরের আত্মহত্যা! কী বুঝলেন? এটা দেখার পর আমি অন্তত ভেবেছি খ্যাতিমান সঙ্গীত শিল্পী আঁখি মারা গেছেন। একটু হলেও শিহরিত হয়েছি। কিন্তু খবর পড়ে জানলাম সিলেটে এক ছাত্রী মারা গেছেন। তিনি নার্সিং ইনস্টিটিউটের ছাত্রী, নাম আখিঁ আলামগীর। সেই হিসাবেতো ঠিক আছে, শিরোনামতো মিথ্যা নয়। তাহলে কেনো আমার জ্বলে? জ্বলে সেই বিভ্রান্তির জন্য। এবং এটা ইচ্ছা করেই করা হয়েছে বলে একটু বেশিই জ্বলে। আমি যখন খবরটা পড়ি, প্রায় ২ হাজারের উপরে পেইজ ভিউ। সেটা দেখে বিশ বছর আগের সেই কৃষকের মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কমপক্ষে ১৯ শ বিভ্রান্ত মানুষকে দেখতে পেলাম।
এটাতো একমাত্র ঘটনা নয়। রোজ ঘটছে এরকম। প্রমানিত একটা সত্য হলো, বাংলাদেশে খবরের সবচেয়ে বড় উপাদান এখন যৌনতা। যেকোনভাবে এর লেশমাত্র পাওয়া গেলে সেটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলাটাই যেনো সাংবাদিকতা। আর অনলাইন দৈনিকগুলোতো বেঁচেই আছে এই নিয়ে। আমার কেনো যেনো ধারণা হয়, এর সাথে জড়িত যারা, তারা সম্ভবত প্রতি মূহুর্তে ধর্ষণ, খুন বা এমনতরো শব্দ দিয়ে গুগলে সার্চ দিতে থাকেন আর সেই সার্চে বান্দরবান থেকে বুয়েন্স আয়ার্স, আলম নগর থেকে আদ্দিস আবাবা যেখানেরই খবর আসুক, সেটাকে নিজেদের মতো করে অনুবাদ করে দিয়ে দেন। কোনমতে একজন অনুবাদ করে ফেল্লেই অবশ্য কেল্লাফতে, তারপর সেটা ভূত থেকে ভূতে হয়ে সকল ২৪/৪২০ পোর্টালে চলে যায়। বাপের হাতে কন্যা ধর্ষিত টাইপের খবরের লিংক ঘুরে বেড়ায় ফেসবুকের হোমফিডে। আমি নিশ্চিত আপনি সেই খবরটা পড়ে শেষ করার আগ মূহুর্তে জানতে পারবেন ওটা এদেশের খবর নয়। দেশীয় কায়দায় খবরটা পরিবেশন করে একদম শেষে বলে দেবে আমাজনের ডায়রী থেকে সংগৃহিত। এরকম উদাহরণ দিতে বসলে শেষ হবে না। লিংক দিতে আরম্ভ করলে সেগুলোতে ক্লিক করতে করতে আপনি পরিশ্রান্ত হয়ে যাবেন। এবং আপনার মুখ ক্রমেই লবনাক্ত হয়ে উঠবে।
কিন্তু এই ঘটনাগুলোকি শুধুমাত্র ২৪/৪২০ রাই ঘটাচ্ছে? এতক্ষণে হয়তো এটাই ভেবে বসেছেন অনেকে। কিন্তু না। এই শিরোনাম, এই সংবাদ দেশের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য, সবচেয়ে বেশি প্রচারিত, সুশীলতার মোড়কে আটকানো প্রতিষ্ঠানেও পাবেন। এরা মুত্রত্যাগ কোন দিকে মুখ করে করা হচ্ছে সেটা নিয়ে খবর ছাপাবে। এরা অপেক্ষাকৃত বেশি অশ্লিল শব্দটাকে আমাদানি করবে। বিকল্প শব্দ থাকার পরেও এদের কেউ শিরোনামে স্বর্ণের বদলে 'সোনা' শব্দটা ব্যবহার করবে। যেমন আজকের প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করনেই আছে ' ৪ রানের জন্য ফসকে গেলো সোনা'

Comments

Popular posts from this blog

বাফর ঠিক্নাই

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

মেঘবাড়ির মানুষেরা সব মেঘেতে লুকাই