ভ্রমণ (আনন্দময়) হয়েছে
বালক বেলায় আমি অবাক হয়ে দেখতাম, দাদা ক'দিন পর পর এখানে যাচ্ছে, সেখানে যাচ্ছে। গাট্টি-বোচকা নিয়ে চলে যাচ্ছে জঙ্গলে থাকবে বলে। আমি লোভাতুর হয়েছি। কিন্তু কি এক মায়ার টানে ঘর ছাড়িনি। শহর ছাড়িনি। অথচ বছর দশেক আগেই আমার হয়ে গেছে স্লিপিং ব্যাগ, ট্রাভেল ব্যাগসহ ভ্রমণের নানান জিনিসপাতি। দাদাভাই সেসব দেদারছে ব্যবহার করেছে। একবার হলো কি, সিলেট স্টেশনে এসে ঢাকার ট্রেন থামলো। আমি, দাদাভাই, আরিফ ভাই, রনি ভাই আর রাজু নামলাম ট্রেন থেকে। স্টেশনে নেমে দেখি বিরাট আয়োজন নিয়ে তাদের বন্ধুরা দাঁড়িয়ে। তাবু, লেপ-তোষক, ডেগ-ডেকচি। তারা ক্যাম্প করতে যাচ্ছে লাউয়াছড়া বা আরো কোন নির্জন জঙ্গলে। আমার বানর টুপি, মাফলার, স্লিপিং ব্যাগ মুহুর্তের মাঝে তিন বন্ধু ভাগ করে নিলো।
তখনতো মোবাইল ছিলো না। দাদাভাই স্টেশন থেকে ফোন করলো বাসায়। জিজ্ঞেস করলো আমি বাসায় পৌঁছেছি কী না। আম্মা না বলাতে, বল্লেন, পৌঁছে যাবো। রাজু আর আমি এক ট্রেনে যাচ্ছি, ইত্যাদি ইত্যাদি। আরিফ ভাইও একি কাজ করলো। শুধু আমার নামের যায়গায় রাজু আর রাজুর নামের যায়গায় আমার নামটা বসিয়ে দিলো। বাসার সবাই জানলো ওরা ঢাকায় রয়ে গেছে। কিন্তু তারা জঙ্গলবাসে চলে গেলো। আমরা দুই বন্ধু এক রিক্সায় বাসায় ফেরার সময় ওদের পুরা দলটারে অভিশাপ দিতে থাকলাম। তালতলায় নেমে যাবার আগে রাজু এমনভাবে কথা বল্লো, যেটার মর্মার্থ হলো, দেখিস একদিন আমরাও... আমাদের দেখা হয়নি কিছুই। আমরা বন্ধুরা মুড়ি মুড়কির মতো ছড়িয়ে পড়েছি সময় হওয়ার অনেক আগেই।
বাস কাউন্টারের সামনে দাড়িয়ে আছি। মুস্তাফিজ ভাই আসলেন। তার পেছন পেছন দেখি লাল টি শার্ট পরা মধু পাগলা আসে। মধু পাগলার কথা কি মনে আছে আপনাদের? সেই যে আমাদের বালকবেলায় বিটিভিতে নাটক হতো, সময় অসময় নাম ছিলো। সেই নাটকে একটা পাগল ছিলো। নাম মধু পাগলা। সেই মধু পাগলা দেখেতো আমি প্রায় ভয়ই পেতে যাচ্ছিলাম। এই পাগলাকে কেন বুড়াভাই সাথে নিয়ে আসলো, সেটা মাথায় ঢুকছে না আমার। কাছে আসতেই ভুলটা ভাঙলো। এই জিনিস মধু পাগলা না। এটা হলো অরূপপাগলু। চুল কাটতে গিয়েছিলো। নাপিত নামের মহামানব এই অবস্থা করে দিয়েছে। না দেখা সেই নাপিতের প্রতি আমি গভীর কৃতজ্ঞতা অনুভব করলাম। এই বেটা সমানে আমারে পাগল বলে যায়। অচেনা একটা নাপিত সেই সাজা তারে দিয়েছে। হে নাপিত তুমি মহান!
বাস ছাড়ার ঠিক আগ মূহুর্তে আমাদের এক বন্ধু ফোন করলেন। অরূপের সাথে তার কথা হলো। না যেতে পারার দুঃখ ছিলো তার কণ্ঠে। অরূপ বিষন্ন হলো। সেই বিষন্নতাটা আমার মাঝেও ছড়িয়ে দিলো সে। এইটা আমাদের সাথে ছিলো পুরো ভ্রমণের সময়টাতেই।
এই রাস্তায় সাভার পর্যন্ত গিয়েছি এর আগে। এরপরেই অচেনা সড়ক। রাতের বাস। আমাদের ঘিরে রেখেছে অন্ধ এক আলো। মাঝে মাঝে অন্যগাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলো আমাদের চমকে দিচ্ছে। আমরা গল্প করছি টুকটাক। সুন্দরবন, সচল আর মানুষের কথা বলছি আমরা।
ফেরিঘাটে পৌছে বাস থেকে নামলাম। সুনামগঞ্জের হাওড় জনপদে কেটেছে আমার সোনালী শৈশব। আমি জল কাদার মায়ায় বেড়ে উঠা মানুষ। ডাবর এর ফেরিঘাট জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। ফেরিঘাট আর ফেরি, সেখানকার মানুষ আমার বড়ো প্রিয়। আমি মুগ্ধতা নিয়ে মানুষ দেখতে থাকলাম। ইতিমধ্যে অন্য দুই ফটুরের সাথে আলাপ হয়েছে। মানুষের সাথে সম্পর্ক হতে বেশ সময় লাগে আমার। এখানেও তাই লাগতো হয়তো। কিন্তু জুবায়ের ভাই সেটা হতে দিলেন না। আমার সাথে তিনিও হাঁটছেন। ছোট ছোট দোকান দেখছি আমরা। ব্যস্ততা দেখছি। বিজলি বাতির আলোয় সবকিছু চকমক করছে। তারপরও অন্যরকম একটা আলো খেলছে চারদিকে। সেই মায়াবী আলো আমাদের মুড়ে রেখেছে পরের চারটা দিন। আলোটা ছড়াচ্ছিল আকাশ থেকে। সে আলো ছিলো চাঁদের আলো।
সেই যে গফফটুরের দল গেলো সুন্দরবনে। ভিজতে ভিজতে আর হাগতে হাগতে তারা ফিরে এলো। আসা অব্দি বার বার শুনছি একটা নাম, বাপ্পিদা। সালাউদ্দিন বাপ্পি। আমাদের ট্যুর অপারেটর। বুড়ি গোয়ালিনীর ঘাটে গিয়ে তাকে পাওয়া গেলো। বিশাল মোটাশোটা লোক। এর অনেক গুন। কিন্তু জেনারেল মুস্তাফিজের কাছে সে নিতান্তই শিশু। তাকে দেখেই জেনারেল একটা ভেটকি দিলেন। এই মিয়া... হ্যান ত্যান বলে ছেড়াবেড়া অবস্থা। সেও দেখি মুহুর্তেই নেতিয়ে পড়লো। খুব অল্পক্ষনের মাঝেই রিফাত-১ নামের ছোট্ট বোটটাতে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থান হলো। জেনারেল সাহেব স্থলবাহিনী ছেড়ে জলবাহিনীতে চলে গেলেন। তিনি বোটের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব নিলেন। আমাদের সুন্দরবন যাত্রা শুরু হলো।
বোট চলতে শুরু করলে আমাকে সেই মুগ্ধতা চেপে ধরে। ক্রমশ পিছিয়ে যায় বুড়ি গোয়ালীনির ঘাট। পরিচিত হয়েছি ইতিমধ্যে আতিয়ার ভাই, ওয়াহাব ভাই, অসিত এবং খলিল এর সাথে। আমাদের সাথে আছেন বনপ্রহরী রেজাউল করিম। কলাগাছিয়া থেকে আরেকজন বনপ্রহরী আমাদের সাথে যোগ দেন। তিনি হলেন এমদাদুল। এদের সবার কথা এখানে বলে ফেলি। এরা এক কথায় চমৎকার মানুষ। খুবি চমৎকার। সারাজীবন মনে রাখার মতো একেকটা মানুষ।
আমার নামধাম মনে থাকে না। (লেখার সময় এদের নাম মনে করিয়ে দিলেন মুস্তাফিজ ভাই।) একটু পর পর তাদের নাম জিজ্ঞেস করেছি পরের চার দিন। এটাতে তারা খুবি মজা পেয়েছে। আর আমি পেয়েছি শরম! আমাদের এক ছোটভাই আছে। নাটক করে। এখন আমেরিকায় থাকে। করিম ওর নাম। ওর বন্ধুরা ওকে ডাকতো এল করিম বলে। পরে সবাইই তাকে এই নামে ডাকতে শুরু করে। আমি একবার জিজ্ঞেস করলাম এই 'এল' টা কি রে? সে আমার কাছে বসা ছিলো। দাঁড়ালো, একটু দুরে গেলো। আমি তাঁকিয়ে আছি তার দিকে। বল্লো, অপুভাই এল এর মানে কি বলতে পারি। তার আগে বলো, তুমি আমারে মারবা না। এই বানরগুলারে আমি অনেক বেশি আদর করি। তবু কোন এক আজব কারণে এরা আমারে খান্ডাল টাইপ কিছু একটা ভাবে। তাদের অনেকেই তুলিরে বুবু বলে ডাকে! ছোটভাইরা শ্বশুরবাড়ির লোক হয়ে গেলে কেমন কষ্ট হয় সেটা আমি ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। আমি বল্লাম, ঠিকাছে মারবো না, বল কি হয় এল দিয়ে। সে বল্লো এল দিয়ে লুচ্চা হয়... বলেই দৌড়, আমি স্বপনের দোকানে মুখ হা করে বসে থাকলাম। রেজাউল করিম এর নাম আমি ভুলিনি এই এল করিম এর সূত্র ধরে। তাকে করিম ভাই বলে ডেকেছি।
ওহাবকে সচলের সবার চেনার কথা। মাহবুব লীলেন সুন্দরবন থেকে ফিরে একটা গল্প লিখেছিলেন। বাঘ শিকারের গল্প। এর নায়ক সম্ভবত এই ওহাব। ওর সাথে কথা বলে সেই গল্পের অনেক টুকরো টাকরা জেনেছি আমি। ওহাব সুন্দরবনের সেইসব সাহসী মানুষদের একজন, যিনি বাঘের সাথে লড়াই করেন। আতিয়ার ভাইকেও আপনাদের চেনার কথা। তার ছবিও আছে সচলে। এই যে নামগুলো বলছি, এরা এমনই ব্যাপক জীবন ধারন করে আছে, যে এদের প্রত্যেককে নিয়ে কয়েকটা করে ব্লগ নামানো যাবে। আমি নিতান্তই এক ক্ষুদ্র মানুষ। তারচেয়ে ক্ষুদ্র এক লেখক। সেই দুঃসাহসের কাজটা আমি নাইবা করি। আমি বরং নিজের কথাই বলি, যেটা করে আসছি এতোকাল ধরে।
বোট এগিয়ে যাচ্ছে। বাপ্পিদা নানান কিসিমের গল্প করছে। তার গল্পের প্রতিটা টার্নিং পয়েন্টে একবার করে ঝাড়ি দিচ্ছেন মুস্তাফিজ ভাই, বলছেন চাপা... চাপা... বাপ্পিদা চরম ধৈর্য্যের সাথে সেটা মোকাবেলা করে গল্প চালিয়ে যাচ্ছেন। হাত তুলে দেখালেন একটা সাদা কাপড় লটকে আছে। ১০/১৫ দিন আগে এখান থেকে একজনকে বাঘ তুলে নিয়ে গেছে। বছর পাঁচেক আগেও লোকটাকে বাঘ ধরেছিলো। নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে রক্ষা পায়। তাকে উদ্ধার করেন বাপ্পিদা। এরপর সে বিয়ে করেছে, তার সংসার হয়েছে, সন্তানের পিতা হয়েছে সে। তারপরও নিয়তিকে হার মানাতে পারেনি। তার বউ এর আঁচল কিংবা ফুটফুটে দুই কন্যার মায়াবি হাতের বাঁধন তাকে ধরে রাখতে পারেনি। দুদিন পর গামছায় বেধে তার লাশ নামের অবশিষ্ঠ মাংশের খণ্ড গভীর বন থেকে নিয়ে এসেছেন বাপ্পিদা! সুন্দরবনের অসীম সাহসী লোকটাকে গল্প করতে করতে বেদনাহত হতে দেখি, দেখি তার চোখে ঝিলিক দেয়... তার সাথি আতিয়ার, যে কী না ভাবলেশহীন মুখে পরের চারটা দিন শুধু গালই খেয়ে গেছে, তাকেও দেখে মনে হয় বেদনায় আহত এক মানুষ। তবে সেটা মুহূর্তের জন্যই বুঝিবা। এক গল্প থেকে আরেক গল্পে দ্রুতই ঘুরে ফেরে বাপ্পিদার কণ্ঠ। আমি মুগ্ধ হই। মুস্তাফিজ ভাই মজা করেন।
একের পর এক নদী খাল পেরোচ্ছি আমরা। সেসবের নামেরও নানা বাহার। কখন কোনটা পেরিয়েছি মনে নেই। একটু আগে মুস্তাফিজ ভাইর কাছ থেকে লিস্ট নিলাম সেসবের। নামগুলো দিয়ে দিই, বুড়ি গোয়ালনী, খোলপুকুর, শাকবাড়ীয়া, হংসরাজ, মাইট্যাভাড়ানী, কেওড়াশুটি আর বালির গাঙ। এরমাঝে দু একটা খালও আছে। তবে আমার সবগুলারেই নদী বলে মনে হয়েছে।
(চলবে)
Comments
Post a Comment