বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

চল্লিশ পেরুলে বয়েস পরস্পরের আলাপের বিষয় হয় ওষুধের তালিকা। কোন কবি বলেছিলেন এই কথা? কোন কবিতায় আছে এই কথা? নাকি কোন গদ্যে?


কথাটা মিথ্যে নয়। নির্দিষ্ট বয়েস পেরুলে পরে বন্ধুদের আলাপেও ঢুকে পড়ে সাম্প্রতিক স্বাস্থ্যবার্তা।


আমরা সিনেমা নিয়া কথা বলি। তত্ত্ব বা তথ্য থাকেনা সেখানে। নিজেদের মধ্যে কার হৃদয়ে ছুরি চিকিৎসা হলো তার গল্প করতে করতে মান্নাদা বলে, সিনেমাটা খারাপনা। দেখতে পারিস। আমরা তরল সিনেমার তালিকা করতে থাকি।


কঠিন বাস্তবতার গল্পগুলো এড়িয়ে যাবার পদ্ধতি নিয়ে আলাপ করি। এ এক প্রাত্যহিক গল্প বলা। সিনেমার দৃশ্যান্তরে ধারাবাহিকতা নিয়ে আলাপ হয়। গল্পের সময়কাল নিয়ে চিন্তা না করা পরিচালককে আমরা গাধা নাম দেই।


মান্নাদা বলে, তুই যেমন ভাবছিস, তেমন না আসলে। অন্ধ একটা মানুষ এই সমাজে যেমন অবিচারের শিকার হয়, তেমন না, বরং প্রতিশোধ নিতে পারার এক সুপারম্যানিয় ঘটনা। সিনেমাটা সিনেমাই। অন্যকিছু না।


কম টাকায় তৈরি হওয়া সিনেমার তালিকা করি আমরা। ভালো সিনেমার জন্য টাকা কোন বিষয় না। কম টাকা দিয়ে বিস্তর ভালো সিনেমা তৈরি হয়েছে।


অন্ধ হলেই বিহঙ্গ পাখা বন্ধ করেনা, সিনেমাটা সেই সূত্রেই হয়তো তৈরি। কিন্তু হিন্দিওয়ালারা রবীন্দ্রনাথ কেনো পড়বে? হয়তো কোন কোরিয়ান সিনেমার নকল! বোম্বে শুধু হলিউড থেকেই নকল করেনা, আরো আরো দেশ থেকেও চুরি করে।


ফারুকীকে নিয়ে কথা উঠলেই আমরা হাসাহাসি করি। কিন্তু সেতো দেশের বড় পরিচালক। আমরা কী? আমরা কেউ না। আমরা রাজা উজির মারা আম পাব্লিক, যাদের সাথে রাজার দুরে থাক উজিরেরও কখনো দেখা হয়না। অথচ আমরা রাজা উজির মারি সর্বদা।


মানুষ হিসেবে আমরা ক্ষুদ্র। আমাদের আনন্দ জমা হয় টিভির পর্দায়, মোবাইলের স্ক্রিনে। সিনেমার বাড়ি এখন ওটিপি প্লাটফর্মে।


আমাদের বয়েস চল্লিশ পেরিয়েছে। আমাদের শরীরে বাসা বেঁধেছে চর্বিযুক্ত শর্করা! নাকী শর্করা যুক্ত চর্বি? কোনকালেই আমি বিজ্ঞানের সন্তান নই, আমি জানিনা শরীরের কলকব্জা।


ক্লাস নাইনে সাইদুর রহমান স্যার বলেন, সাইন্স নেরে নজমুল। আমি বলি, না স্যার, মাথায় কুলাইতনায়। আমি পরিবেশ পরিচিতি সমাজে মন দিয়েছিলাম। আমাদের সিনেমাও সর্বদাই সামাজিক। সামাজিক এ্যাকশন...


এই সমাজ এ্যাকশন ভালোবাসে। অথচ আক্রান্ত হৃদয় নজমুল আলবাবরা সেসবে নিজের ভূমিকায় ঠিকঠাক অভিনয় করতে পারেনা। না পারার বেদনায় অক্ষম আক্রোশে কাঁপতে থাকে। রক্তের চাপ উর্ধ্বমুখী হয়। হাতে বাঁধা ছোট কাঁচে ভালোবাসার চিহ্ন ভেসে উঠে, মিলিয়ে যায়, বিপ শব্দ হয়।


আমাদের আঁকাআকির ক্লাসে একজন দু'জন ছিলো শুধু ভালো আঁকতে পারতো। বাকিরা লবডঙ্কা। অথচ সবাই আমরা পানপাতা আঁকতে পারতাম। আমরা ইঁচড়েপাকা ছিলাম। আমরা লাল রঙ দিয়ে লাভ সাইন আঁকতাম। আমাদের পছন্দের সিনেমা ছিলো চাঁদনি। শাবনাজ নাঈমের। আমরা তরল ছিলাম।


তারপর আমাদের গোঁফ গজালো। আমরা ক্রমেই ভাব নিতে শিখলাম। আমরা মোটা মোটা বই আর ভারিক্কি সিনেমা দেখতে শুরু করলাম। আমাদের কেউ কেউ চশমার মালিক হলাম।


অথচ এখন সেইসব সিনেমা থেকে আমরা পালিয়ে বেড়াই। আমরা আবার তরল হয়ে পুষ্পা দেখি... ঝুঁকেগা নেহি! কিন্তু আমরা ঠিকই ঝুঁকে গেছি প্রত্যেকে। আমাদের মেরুদণ্ড ক্রমেই ভঙ্গুর হয়ে উঠেছে।


সিনেমার বিবরণ পড়ি। মেরুদণ্ডে শিরশির হতে পারে এমন কোন উপাদান আছে কীনা সেটা দেখি। অকেজো হতে চলা হৃদয়ে ঠিক কোন প্রতিক্রিয়া হবে তার হিসাব নিই। আরো নিশ্চিত হতে দেখি ট্রেলার।


নড়াইলের বিবরণ পড়ে বুঝি এই দৃশ্যকল্প আমার জন্য নয়। তারপরও ট্রেলার দেখা হয়ে যায়। নিঃশ্বাস ভারী হয়। পরিবেশ অপরিচিত সমাজ আমাকে থাপড়া দেয়। দিতেই থাকে। আমার গলায় ঝুলতে থাকে জুতোর মালা। আমার মাথায় কেউ ঢেলে দেয় ময়লার ভাগাড়...


আমাদের বিহঙ্গ অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা। আমরা উড়তে পারিনা। নায়ক অন্ধ হলেও লড়াই করতে পারে, কারন সেটা সিনেমা। পরিবেশ অপরিচিত পঁচা গলা সমাজ বিজ্ঞানে দুর্বলেরা কিছুই পারেনা। আমাদের জীবন বাঁধা পড়েছে নিয়মে। আমরা দেখি তরল সিনেমা।

Comments

Popular posts from this blog

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা