শুভ হালখাতা

নববর্ষ বলে কিছু চিনতাম না তখন। চিনতাম হালখাতা। স্মৃতির ছড়ানো মুড়ি মুড়কি জড়ো করতে গেলে যে উজ্জল সময়টা সামনে আসে, সেটা সম্ভবত ৯৩/৯৪ সাল হবে। ইংরেজি ৮৬/৮৭।


জগন্নাথপুর বাজারে কাকাবাবুর দোকানে নতুন খাতা খোলা হতো। একদম সকালে হাড়িতে করে মিস্টি চলে আসতো। এরপর আব্বার হাত ধরে চলে যেতাম বাজারে। দোকানের ভেতর থেকে ডাক আসতো, ' ও মাস্টসসাব, আউক্কাতে...' আব্বা হাত নেড়ে বলতেন, 'থুড়া চক্কর দিলাই আগে...' আব্বার চক্কর বলতে লম্বা কোন দৌড় ছিলোনা। নির্দিষ্ট কয়েকটা দোকান ঘুরে তিনি কাকাবাবুর গদিতে এসে বসে যেতেন। ততক্ষণে মিস্টিতে আমার পেট টইটুম্বুর হয়ে যেতো। আব্বা মাথা নাড়লে আমি হাফপ্যান্টের কোমরে ধরে দিতাম দৌড়! ( হাফপ্যান্টের কোমর ধরা বিষয়ে নিজের কোন স্মৃতি নাই। আমার শৈশব বেঁচে আছে যাদের স্মৃতিতে, তারা বলেছেন এই গল্প!) আম্মা ভালো দেখে শাড়ি পরতেন। পোলাও রান্না হতো। এসবই আসলে বিচ্ছিন্ন বৈশাখের স্মৃতি।


ফুফুত ভাই করিম, আমাদের বাড়িকে শিন্নি বাড়ি বলতো, তার কারণ মনেহয় এই যে, এমন কোন দিনে সেও ফুফার সাথে মাদানে খেতে এসেছিলো আর আম্মা তাকে মুরগির মাংসের সাথে পোলাও তুলে দিয়েছিলেন পাতে। করিম অভিমানে সব ছেড়ে অন্য পৃথিবীতে চলে গেছে।


সেইসব দুপুরে বারান্দায় পাটি পেতে বসে খাওয়া হতো। অফিস ছুটি তবু আরজু ভাই কিংবা সোনামুদ্দি ভাই আসতেন। আমাদের খাবার অর্ধেক শেষ হলে দাদাভাই বিশ্ব জয় করে ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হতো। তার পা ভর্তি থাকতো ধুলাবালি। উঁচু বারান্দায় পা লটকে নাতাভুতার মতো খেয়ে সে আবার দৌঁড়ে কোথাও চলে যেতো। আব্বা তখন গরম চোখে আম্মার দিকে তাকাতেন। খাবার শেষে দুপুর নির্জন হবার আগ পর্যন্ত আমি আম্মার পেছন পেছন ঘুরঘুর করতাম। আব্বা হয়তো ডাক দিতেন, ও বিলাইর বাইচ্চা আয় বাপ্পুত ঘুমাই থাকি। দিনে আমার ঘুম হতো না। এমন এক দুপুরে সারা বাড়ি ঘুমিয়ে পড়লে কাঠ কাটতে গিয়ে আমি হাত কেটে ফেলেছিলাম। কাটাছেঁড়ার সেই শুরু...


দুয়েকটা হালখাতা রোজায় হয়েছিলো। নানাবাড়িতেও আমাদের অনেক বৈশাখ কেটেছে। নানাবাড়ির বাক্সো খুললে প্রজাপতির ঝাঁকের মতো স্মৃতিগুলো বেরিয়ে আসতে থাকে। ধান, মাড়াই, পিঠা কিংবা বাঘা হাওরের উদারে হারিয়ে যাওয়া আমার মগ্ন শৈশব।


দিরাইয়ে কালনী নদীর পারে ছিলো হলুদ রঙা বাড়ি। পেছনে কদমের সারি, তারপর মনোয়ারা মনজিল। আমাদের জননীরা পাট ভাঙা শাড়ী পরতেন। আমারও তখন বাইরে যাবার বয়েস হয়েছে। আব্বা আলাইর ঘরের মিস্টি আনাতেন। আসিক ভাই এক-দুবার এলুমিনিয়ামের জগ ভর্তি করে ছোট ছোট মিস্টি এনেছিলেন মনে আছে। সেসবে দুধের ঘ্রাণ লেগে থাকতো। মার্কুলি বাজারের মিস্টিতেও এমন ঘ্রাণ পাওয়া যেতো। জ্যাঠু ঠোঙায় করে আমার জন্য সেসব মিস্টি আনতেন। মাঝে মাঝে আনতেন বুন্দিয়া। জ্যাঠুর কাছ থেকেই বুন্দিয়াকে মি'দানা বা মিহিদানা বলা শিখেছিলাম আমি।


তারপর একদিন হুট করে আমরা সেইসব মাটিগন্ধা মফস্বল ছেড়ে চলে এলাম শহর সিলেটে। পরে যে শহরকে আমি জীবনেরই মতো প্রিয় বলে জেনেছি। যেখানে বৈশাখ আসতো প্রবল বেগে। আনন্দে। প্রকৃতপক্ষে বৈশাখ বলতে যা কিছু আছে তা আমি সিলেটে এসেই শিখেছি। সিলেট হয়তো আমার জন্ম শহর, হয়তো এই শহরটাতেই আমার সকল জ্ঞাতি গোষ্ঠী আছেন এ পাড়ায় ও পাড়ায়। তবু আমার নদী আসলে সুরমা নয়। আমার নদী হলো তার কন্যা কালনী। প্রান্তিকের বৈশাখী মেলা প্রবলভাবে মনে পড়ে সবসময়। কিন্তু যখন চোখ বন্ধ করে পয়লা বৈশাখ কিংবা হালখাতাকে দেখি সেটা আসলে জগন্নাথ পুরের বাজার হয়েই ভেসে আসে। আব্বা আমার হাত ধরে হাটছেন। কেউ একজন হঠাৎ হাতে একটা ঠোঙা ধরিয়ে দিলেন। ওতে মুড়কি, নকুলদানা, বাতাসা ঠাসা থাকতো...


আজ এই একা বৈশাখে চোখ বুঁজে আমি কালনী নদীর পার ধরে ছুটতে ছুটতে ধলের মেলায় হাজির হই! যেটা আসলে ফাল্গুনের মেলা! স্মৃতির নদী এমনই, একবার দরোজা খুলে ঝাপ দিলে কোন কুল থেকে কোন কুলে নিয়ে যায় সে কেউ জানেনা।

-------------------------

পহেলা বৈশাখ ১৪২৭

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা