ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

ফুপু বছরে একবারই আসতেন। বাক্স পেটরা বোঁচকা বুচকি নিয়ে। তখন আমরা বিশ্বনাথে থাকি। লাল ইটের একটা বাড়ি। খোলা উঠান। বড় খেলার মাঠ। বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে রামসুন্দর উচ্চ বিদ্যালয়, মসজিদ, প্রাইমারি স্কুল। ফুপু এলেন রোজার আগে। এসেই আমাদের সবাইকে জড়িয়ে ধরে এক প্রস্ত কান্নাকাটি করলেন। বিলাপ দিয়ে কান্না। আব্বা বল্লেন, কান্নাকাটি শুনলে মানুষ ভাববে, পোস্ট মাস্টার মারা গেছে... ফুপু এ কথা শোনে আরো জোরে কাঁদতে শুরু করলেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে আব্বা সুড়ুৎ করে বেরিয়ে গেলেন। হয়তো রনজিত কাকার সাথে আড্ডা দিতে। কাকা তখন রামসুন্দর স্কুলের শিক্ষক। দীর্ঘ বছর পর দুই বাল্যবন্ধুর দেখা হয়েছে তখন। তারা চুটিয়ে সেই সময়টা উপভোগ করেছেন।


কান্নাকাটি এবং আমার কেউ নাই বিলাপ শেষ করে ফুপু ব্যাগের ভেতর থেকে ছোট একটা কাঁথা বের করে সেলাই করতে শুরু করলেন! এটা এতই ছোট ছিলো যে, তখনকার পিচ্চি হাসানের কাঁথাও এরচে বড় ছিলো! আমাদের ঘরে তখন সকাল বিকেল লুডু খেলা হতো। বলতে গেলে লুডুর বোর্ডের মাপের সেই কাঁথা। বিস্ময় নিয়ে কাথা তৈরি দেখতে থাকলাম। ফুপু অসাধারণ সব সেলাইয়ের কাজ জানতেন তখন। দেখতে দেখতে কাথাটা আস্ত একটা নকশায় পরিণত হলো। সেলাইয়ের ফোড় গুলো কাঁথার মাঝ বরাবর ঘন হয়ে গেলো আর একদম কেন্দ্রে একটা ফুটো তৈরি করলেন ফুপু। আমার বেশ মন খারাপ হয়েছিল। কারণ প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে ততদিনে এই উত্তর পেয়ে গিয়েছিলাম যে, যা তৈরি হচ্ছে তার মালিক আসলে আমি। সেই মালিকের অনুমতি না নিয়ে একেবারে মাঝ বরাবর ফুটো করাটা মেনে নিতে পারিনি।


তখন অনেক ঘুমাতাম। এতো ঘুমাতাম যে সমবয়সী সবাই রোজ স্কুলে গেলেও আমি সপ্তায় দুয়েকদিন যেতাম। রোজা শুরু হয়ে গেছে। সিলেটে আমরা সেহরিকে ফতা বলি। আমাকে কেউ ফতা খেতে ডাকেনা। প্রায় দুপুর হবার মুখে ঘুম থেকে উঠে পা ছড়িয়ে ফতায় না ডাকার প্রতিবাদে কান্নাকাটি করি। রুহি আপা রামসুন্দর স্কুলের বড় একটা ক্লাসে পড়তো। বোন হিসাবে অত্যন্ত মায়াবতী ছিলো। কিন্তু এই সেহরী বা ফতা নিয়ে সে নিষ্ঠুর আচরণ করতো। আমি যখন বেদনায় নীল হয়ে কাঁদছি সে তখন ফতার খাবারের লোভনীয় বর্ণনা দিতো। তার ল্যাংবোট ছিলো দাদাভাই। কীভাবে কীভাবে যেনো শেষ রাতে উঠে যেতো আর আমাকে যন্ত্রণা দিতো। আমার ধারণা ছিলো, কেউ আমাকে ইচ্ছে করেই ডাকছেনা। এরকম সময়ে নানাবাড়ির কমলা গাছের নিচে কোন এক ভোরে কুড়িয়ে পাওয়া শিশুটাই যে আমি, তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতাম। ঘ্যান ঘ্যান করে সেই কান্না অনেক্ষণ চলতো।


এমনি এক প্রায় দুপুরে শান বাঁধানো উঠোনে গগনবিদারী চিৎকার করছি যখন, ফুপু তার শীর্ণ শরীর নিয়ে আমাকে সামলে সুমলে রান্না ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে ছড়ানো ছিটানো নানান আয়োজনে বসিয়ে দিতেই আবিষ্কার করলাম আমার কাঁথা ভর্তি করা পিঠার গোলার মতো কিছু একটা। ফতা না খাবার কষ্টের সাথে এই নতুন নির্যাতন আমার বুকে শেলসম বিধলো যেনো। কাঁথার দুঃখে তব্দা লেগে গেলাম। সেই অবস্থাতেই দেখলাম, ফুপু কাঁথাটা হাতে নিয়ে চাপ দিয়ে চুলায় গরম হতে থাকা তেলে গোলা দিয়ে নকশা করতে শুরু করেছেন! কী নিখুঁত একেকটা নকশা। বাজারে মিস্টির দোকানে সাজিয়ে রাখা আমির্তির মতো। কোন কোনটা সাধারণ প্যাঁচ। ততক্ষণে আমি ফতা না খাবার দুঃখ ভুলে গেছি। কাথা নষ্ট হবার বেদনা বলক ওঠা তেলে ডুবে মরেছে। আম্মা দ্রুত হাতে তেল থেকে সেই প্যাঁচগুলো নামিয়ে পাশে রাখা পাত্রে রাখছিলেন। ওটা ছিলো চিনির সিরা। তারপর রসে চুবানো জিলাপি তুলে রাখা হলো বউলে। ফুপু বল্লেন, আমার আব্বারে জলদি দেওগো রুকিয়া। আম্মা সাদা রঙের পিরিচে গরম একটা জিলাপি ভেঙে ফুঁ দিয়ে সেটা ঠান্ডা করে আমার মুখে দিলেন। কমলা গাছের নিচে থেকে কুড়িয়ে আনলেও আম্মা সত্যি সত্যি আমার আম্মা সেই বিশ্বাসটা আবারও ফিরে এলো মনে। সেই প্রথম আমি বুঝলাম মিস্টির দোকানের লোকটার অনেক ফুপু আছেন, যারা কাঁথা দিয়ে এমন জিলাপি বানিয়ে দোকান ভরে রাখেন!

............................

২৮ এপ্রিল, ২০২০

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

মিহিদানা