হাসপাতালের দিনগুলো

তখন পাতলা ঝোলের মুরগির মাংস আর আলু দিয়ে একটা তরকারি থাকতো, সাথে ডাল আর মোটা চালের ভাত। বড় বড় সসপ্যান ভর্তি করে ট্রলিতে ঠেলতে ঠেলতে ওয়ার্ডের মাঝ বরাবর এসে দাঁড়াতেন মাসি অথবা ওয়ার্ডবয়।

ওসমানী হাসপাতালে গাইনি ওয়ার্ডের সেইসব দিনে, আমার শৈশবে ফিরে গেলে অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন আর আন্তরিকতার দেখা পাই। এলুমিনিয়ামের টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে সেখানে যারাই যেতেন, দুরন্ত ক্ষ্যাপা আমাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা তাদের কারো ছিলোনা।

সাদা বিছানায় পা তুলে গুটিসুটি মেরে বসে থাকার নিয়ম ছিলো। খাবারের ট্রলিতে আসা ঘ্রাণের দিকে আড়চোখে তাকাতাম। একদিন আম্মা বলেন, "খাইতায়নি"? আত্মবিশ্বাসহীন কণ্ঠে হ্যাঁ বলি। আম্মা প্লেটে করে অল্প একটু ভাত, হলুদ রঙের ছোট্ট এক টুকরা মাংস আর আলু নিয়ে আসেন। আমি বিছানায় বসে পা দোলাতে থাকি, আম্মা ভাত মুখে তুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করেন, "মজা"? আমি মাথা নাড়ি শুধু। আবার জিজ্ঞেস করেন, "আম্মারটার চেয়ে বেশি"? আবারও মাথা নাড়ি। আম্মা হাসেন। এরপর যতদিন খাবারের সময় হাসপাতালে গেছি, আমি না চাইলেও ট্রলিওয়ালা মাসি খাবার দিয়ে যেতেন আমার জন্য। বলতেন, "পুয়ায় মজা করি খাইন দিদি, খাওয়াইয়া দিলাইন"।


...
ডিসেম্বরের তীব্র শীতের রাতে আমাদের বাপ ছেলেকে যখন একা একটা ঘরে প্রায় বন্দী করা হলো, তখন তেমন ক্ষিদে ছিলোনা আমাদের। ঘন্টা দুয়েক আগে চুরি করে আমরা চিকেন এন্ড চিপস সাঁটিয়েছি। নিষিদ্ধ কোক খেয়েছি। রুমে ঢুকে প্রথম কয়েক মিনিট আমরা একে অপরের দিকে তাকালাম। ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছি। দরোজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো। গম্ভীর মুখে একজন এলেন। থেমে থেমে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করলেন, " খবরটা ভালো না, শিশুটি (!) কোভিড পজিটিভ। বাপ ছেলে যেভাবে কচলাকচলির মাঝে ছিলেন, দুজনকেই বন্দী করতে হলো। পরবর্তী সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে!"

বন্দী বিষয়টার মর্মার্থ প্রথম ধরতে পারলো আমাদের উদর। তখন রাত তিনটার মতো বাজে। উদর বল্লো, এটা রাত তিনটা নয়, সকাল সাতটা। এটা প্রাতঃরাশ গ্রহণের সময়। একদম মিছা কথা। আমরা বাপ ছেলে কখনোই সকল সাতটায় পেটপূজা করিনা। উদর সাহেব যেকোনভাবেই হোক, যিনি আমাদের বন্দী করেছেন, তাঁর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হলেন। কতিপয় বিস্কুট নিয়ে তিনি হাজির হলেন, সাথে চা এবং কমলার রস! তাৎক্ষণিকভাবে সেটা বেশ কাজে আসলো। পরের কয়েক ঘন্টা বাপ ছেলেকে, ছেলে বাপকে কিছু হয়নি, সব ঠিকঠাক আবহ উপহার দেবার নাটক করে গেলাম।

জেলখানায় আমদানি ওয়ার্ড নামের একটা এলাকা আছে। নতুন আসামিদেরকে সেখানে রাখা হয়। প্রথম রাত সেখানে রেখে, যার যার নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে পরের দিন পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের আমদানি ওয়ার্ডের মেয়াদ সব মিলিয়ে বারো ঘন্টার একটু বেশি হলো। যার শেষ পাঁচ ঘন্টা কাটলো আলাদা রুমে।

সকাল সাতটার দিকে জানা গেলো আমাদের জন্য মূল জেলখানায় কক্ষ প্রস্তুত। আমদানি এলাকা ছাড়তে হবে। মোটামুটি ভিআইপির সম্মানে দশ মিনিট হাঁটা দুরত্বের সেই কক্ষে চালান করে বিশাল দর্শন সিকিউরিটি ভাই বিদায় নিলেন। একজন এসে দরোজায় দাঁড়িয়ে নিয়ম শোনাতে লাগলেন, রুম থেকে বের হওয়া যাবেনা। মাস্ক খোলা যাবেনা। কেউ দেখা করতে আসতে পারবেনা... ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা সব মেনে নিলুম।

এলাকার বড়ে গুন্ডি এসে বল্লেন, অনেক হয়েছে। বাপকে এখন বিদায় নিতে হবে। আমি বলি, কাভি নেহি। তিনি বলেন, ছেলে বালেগ হইছে। সাথে থাকার নিয়ম নাই। সতেরো হইলে আমরা বড় বলি। আমি বলি, খামোশ! আমার পোলার বয়েস ষোল! সতেরো হইতে এখনও তেত্রিশ দিন বাকি। তিনি বলেন, এসব বলে লাভ নাই, যেতেই হবে। আমি বলি, চুদুরবুদুর চইলতন! ছেলে একলা থাকবেনা। নিতান্ত অনিচ্ছায় ছেলে বলে, হ থাকতে হবে। বাপ ছাড়া আমার চলবেনা।

মহিলা বিদায় হলে, ছেলে বলে, "বাবা কেনে ইতা করো! যাওনা ঘরো, আমিতো ঠিক আছি।" আমি বলি, "ও আইচ্চা! তে যাইগি।" ছেলে বিরক্ত হয়ে বলে, "আবার ইমোশনাল গেইম খেলা আরম্ভ করলায়নি! থাকো, যেতা ইচ্ছা, ওতা করো!"

আমদানি ওয়ার্ডে আমাদের জন্য বরাদ্দ প্রাতঃরাশ নিয়ে এলেন একজন। এই ওয়ার্ড থেকে সকালের খাবার দেবেনা। তবে দুপুরের তালিকায় নাম থাকবে। একটু পরেই একজন খাবারের মুখস্থ মেনু বলে, অর্ডার নিতে এলেন। কিন্তু সেটা একজনের জন্য! এলাকার গুন্ডি বলে দিয়েছেন, আমার রেশন বন্ধ!

দুপুরের শুরুতে কাচের দরোজার ওপাশে দেখি বড় একটা ট্রলি এসে থামে। বয়েসের ভারে ঝুঁকে পড়া এক জননী চোখের একদম কাছে এনে তালিকা দেখেন আর তুরতুর করে একেকটা রুমে গিয়ে খাবার দিয়ে আসেন। কাচ ভেদ করে ঘ্রাণ আসেনা এখানে, তবু আমি যেনো ঘ্রাণ পাই। তিনি দরোজা খুলে ওভারবেড টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়ে যান। আমাকে দেখেন। আমি জিজ্ঞেস করি, কেউ কি এখানে আছে, যে আমাকে দোকান থেকে খাবার এনে দিতে পরবে। মাথা নেড়ে না বলেন।

ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, বাবা এখানে অনেক খাবারতো। আমাদের দুজনের চলবে এতে। আমি বলি, তুমি খাাও। ওয়ার্ডবয় আসুক, খাবার আনাবো ক্যান্টিন থেকে। মিনিট পনেরো পরে আবার দরোজায় এসে দাঁড়ালেন, তারপর মাথাটা অল্প গলিয়ে বলেন, একটা খাবার বেশি আছে, এনে দেই? "না" বলার প্রশ্নই আসেনা। খাবারের ট্রে হাতে তুলে দিয়ে বলেন, নিয়ম নিয়ে ভাবতে হবেনা। রাতের খাবার দুজনকেই দেবো!

আমাকে কোনকিছু বলার অবকাশ দেয়না মন। একটানে তিরিশ বছর আগের সেই ওসমানী হাসপাতালে চলে যায় সে। সেই ভীষণ ভীড়ের খাবার ট্রলি। অল্প মসলার মুরগির তরকারি, এলুমিনিয়ামের বাটি ভর্তি ডাল, মোটা চালের ভাত... কানে বাজে, "পুয়ায় মজা করি খাইন দিদি"... তার সাথে এই বিদেশি ভাষার কোন অমিল পাইনা...


জীবন বিস্ময়কর। মানুষ অদ্ভুত।

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা