প্রিয় ময়না ভাই


যে শহর ছিলো হাতের তালুর মতো পরিচিত। যে শহরে অনাত্মীয় ছিলোনা কেউ। সেই শহর আর আগের মতো নেই। তারপরও শহরটায়, ছায়া প্রচ্ছায়ায় কিছু মানুষ আছেন, ছিলেন।


ময়নাভাই আছেন থেকে ছিলেন হয়ে গেলেন! আমাদের ছোট্ট শহরের উজ্জ্বলতম বাতিঘর নিভে গেলো অবেলায়। অবিরাম আলোর জোনাক ছড়ানো মানুষটি চলে গেলেন।


ময়নাভাই, যার অপার্থিব আস্তিন ধরে ঝুলে থাকতো আলো প্রত্যাশি কিশোর তরুণ। সেই আস্তিন গুটিয়ে চলে যাবার আগে তিনি মুঠো মুঠো স্মৃতি ছড়িয়ে গেলেন।


ময়নাভাইয়ের সাথে পরিচয়ের কোন আনুষ্ঠানিক স্মৃতি কী আমাদের কারো আছে? সুরমার সাথে শহর সিলেটের যে সরল সম্পর্ক, ময়না ভাইর সাথেতো আমাদের তেমন সম্পর্কই ছিলো। কখন, কেমনভাবে আমরা তার সাথে জুড়ে গেলাম আর কখন কেমনভাবে তিনি আমাদেরকে চিনে নিলেন তার কোন নির্দিষ্ট দিন তারিখতো নাই।


ময়নাভাই অনেক কথা বলতেন। প্রতিটি কথা ছিলো প্রয়োজনীয়। তিনি যতো কথা বলতেন তারচে বেশি কথা থেকে গেছে না বলা, কারণ আমরা সেই কথাগুলো বলাতে পারিনি। মহীরুহের ছায়ায় লতাগুল্মের মতো ভীড় করা সব মানুষ আমরা। আমাদের ওতো জানার সময় কোথায়? তাই ময়নাভাই তার জ্ঞান বৃক্ষ নিয়ে চির প্রস্তানে চলে গেলেন।


মুক্তোদানার মতো কোমলসব স্মৃতি, দুপুরের রোদের মত প্রখর একেকটা গল্প। শিল্পকলার বারান্দা থেকে প্রান্তিকের দুচালা টিনের ঘর। সাহেব বাজারের চড়ুইভাতি থেকে প্রত্যন্ত ছাতার গ্রাম। এই গ্রামটা, সেই দুরের গ্রামে আপনি আমাকে কী উজ্জ্বল স্মৃতি উপহার দিয়েছিলেন ময়নাভাই, না ভোলা সেই গল্প বলি।


সেটা ছিলো শীতের সময়। জড়িয়ে পড়েছিলাম একটা সিনেমার সাথে। বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তান আর্মির পোষাক যখন বের হলো, খুবই আশাহত হয়েছিলাম। আরো দুয়েকজনের অবস্থাও একই রকম হয়েছিলো। পোষাক পরিকল্পনা যিনি করেছিলেন, তিনি প্রাথমিক গবেষণাও সম্ভবত করেননি। পরিচালকের সাথে কথা বলার পর বুঝলাম, তিনিও হতাশ। কথার ফাঁকে জানতে চাইলেন, সিলেটে এ বিষয়ে কথা বলার মতো কেউ আছেন কীনা। শূন্য সেকেন্ড লাগেনি আপনার নাম নিতে। আর কোন গতি নাই তাই যোগাযোগ করার জন্য পরিচালকের সম্মতি পেয়েছিলাম।


ফোন করতেই, এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন, কিন্তু রাত ছাড়া সময় দিতে পারবেন না। গোয়াইনঘাটের ছাতারগ্রাম থেকে লামাবাজারে আপনার বাড়িতে আসতে আসতে রাত দশটা বেজে গিয়েছিলো, তারপর কখন রাত একটা বেজে গেলো, কেউ টের পেলোনা।


সাদা কাগজে বলপয়েন্ট কলমের আঁকিবুঁকিতে নিখুঁতভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রেঙ্ক, ব্যাজ, কাপড়ের বর্ণনা লিখছেন আপনি। সিনেমার গল্প শোনে বলছেন, এরকম হবার কথা না, অন্যরকম হবে। প্রতিটি বাক্যে প্রবল বিশ্বাস ছড়ানো। সোফার এক কোনায় বসে যতটা না মুগ্ধ হয়েছিলাম, তারচে বেশি অহংকার হয়েছিলো। উন্নাসিক ঢাকাকে, গ্রামগুলো মরে যায়নি, এই বার্তা পৌঁছে দেবার আনন্দ দিয়েছিলেন সেদিন। আর পরেরদিন নিজের জরুরি কাজ রেখে হাজির হলেন সেই দুরের গাঁ, ছাতারগ্রামে!


সেই সিনেমাটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু সিনেমা সংশ্লিষ্টরা দেখা হলেই আপনার কথা জিজ্ঞেস করতেন। আপনি এমনই এক প্রবল মানুষ ছিলেন ময়নাভাই, হালকা পরশটাও ছাপ রাখার মতো করেই দিতেন।


বিঙ্গোবোর্ডের নাম্বার কলে আপনার বলা উপমাগুলো কখনো ভুলবনা ময়নাভাই। শহর সিলেট আপনাকে মনে রাখবে। বাংলাদেশ তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে আগলে রাখুক, মায়ায়-মমতায়। বীর মুক্তিযোদ্ধা নিজামউদ্দিন লস্কর, আপনাকে লাল সালাম। আপনার করকমলে এই মুগ্ধ  অনুজের শ্রদ্ধা রইলো।


জানুয়ারি ২২, ২০২১। ফেসবুকে লিখেছিলাম।

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা