লোকটা চাঁদকে বড় বেশি ভালবাসত...


সেটা আমার প্রথম সুনামগঞ্জ যাত্রা। বন্ধুরা মিলে গেলাম। বড়দের মাঝে ছিলেন নূর ভাই আর টুকু’দা। শহর সুনামগঞ্জে আমাদের দুঃসম্পর্কের কয়েকজন বন্ধু ছিল। যাদের কেউ কেউ এখন কাছের বন্ধু হয়ে গেছে।

সেদিন আমরা বসেছিলাম সুনামগঞ্জের পৌরসভা কার্যালয়ে। নির্দিষ্ট করে বল্লে পৌর চেয়ারম্যানের কক্ষে অবাক করার মত ঘটনা হতে পারত এটা। কারণ আমার বন্ধুরা কেউ রাজনৈতিক পান্ডা ছিলনা। ওরা ছিল কবিতার কামড়ে অস্থির তরুন-তরুনি। আর সেই শহরের চেয়ারম্যান ছিলেন মমিনুল মউজদীন। কবি পুরুষ। যিনি চাঁদের রাতে নিভিয়ে দিতেন শহর সড়কের সব বাতি। তাই চেয়ারম্যানের রুমে বসে সেদিন আড্ডা দেয়াটা স্বাভাবিক ছিল।কতবার নির্বাচিত হয়েছিলেন মউজদীন ভাই? তিনবার মনে হয়। হাছন রাজার প্রপৌত্র চাঁদকে যেমন ভালবাসতেন তেমনি ভালবাসতেন কবিতাকে আর অতিঅবশ্যই মানুষকে। আচ্ছা আমি এভাবে বাসতেন লিখছি কেন? হ্যা লিখছি, লিখতে হচ্ছে। কারণ মানুষটা আজ চলে গেছেন! চলে যেতে হয়েছে তাকে। স্বপরিবারে। জিবরান, মউজদীন ভাইয়ের ছেলে। কবির নামে নাম রেখেছিলেন, সেই জিবরানও চলে গেছে আর গেছেন মউজদীনের স্ত্রী। ঢাকা থেকে ফিরছিলেন। ব্্রাম্মন বাড়িয়ার কাছে সরাইলে ঘটেছে ঘটনাটা। বিপরিত থেকে আসা যাত্রিবাহী কোচের ধাক্কা।

জিব্রানকে আমি দেখেছি দশ বছর আগে। ১৯৯৭ সালে। শাহজালাল ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত বাউল উৎসবে। সে উৎসবে মউজদীন ভাইয়ের সাথে হাছন রাজা নামের বানান নিয়ে সেকি তুমূল তর্ক...। প্রথম পরিচয়েই ঝগড়া। দু’বছর পরে মনে হয় গিয়েছিলাম সুনামগঞ্জে। ফিরে এসে ছোট একটা লিখায় লিখেছিলাম, মউজদীন লেজেহুমু’র মত রাজনৈতিক ধান্দাবাজ কবি নয়। তিনি প্রকৃতই কবি। আমার এই স্বিকৃতি তারজন্য গগুরুত্বপূর্ন কিছু নয়। তবু তিনি খুশি হয়েছিলেন খুব। আমাকে চিনতে পারেননি। তবু নিজের লেখা একটা কবিতার বই আমার জন্য পাঠিয়েছিলেন। আমার এক বন্ধুর কাছে দেয়া সেই বইটা কোনদিনই পাইনি যদিও তবু দারুন এক আরামবোধ ছিল সেই বই প্রাপ্তির খবর।

বছরখানেক পর আবার দেখা হল। পুরনো তর্কের মানুষ আর ক্ষুদ্র সেই লিখিয়ে একি মানুষ মেলাতে পেরে দারুন খুশি হয়েছিলেন। এরপর আর তেমন যোগাযোগ নেই। মাঝখানে দুবার আমার পত্রিকার জন্য লেখা চেয়ে আলাপ হয়েছিল। এই যা।

গত কয়েকদিন ধরে আবারও যোগাযোগের একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল। সুনামগঞ্জে বাউল উৎসব করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। যতদুর জানি তার পুরো প্রস্তুতিই সারা হয়ে গিয়েছে। এবারের ঢাকা যাত্রায় বড় ছেলেকে দেখার পাশাপাশি এই অনুষ্ঠানের অনেক কাজ করার কথা। তো উৱসবের খবর শুনেই ঠিক করেছিলাম যাব সেখানে। সহকর্মী সামস শামীম আমাকেও সম্পৃক্ত করার একটা ইশারা দিলেন। জানালেন, উৎসবের স্মরনিকাটা তিনি ছাপার দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন। তার সেই কাজে আমার সহযোগ দরকার। এই মূহুর্তে বেকার আমার জন্য এটা ছিল দারুন ব্যাপার... সেই দারুন ব্যপারটা মনে হয় আর ঘটলনা। মউজদীন ভাই চলে গেলেন। বড় অসময়ে, খুব বেশি অবাক করে দিয়ে... ভাল্লাগছেনা একেবারে। একবারেইনা...

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা