কয়েক টুকরো দিন যাপন আর একটা আলোচনা

ছোট শহরে থাকলে অনেক কিছুতেই সরাসরি অংশ গ্রহনের সুযোগ মিলে বা অনেক কিছুতেই জড়িয়ে পড়তে হয়। বুঝতে শেখার পর থেকে শহীদ মিনারে যাই। একটু বড়ো হয়ে রাতের প্রথম প্রহরে যেতে শুরু করেছি। তারপর কোন ফাঁকে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের সহায়তাকারী হয়ে গেলাম। হিসাব করলে দেখি সেও ১২ বছরের অধিক। গ্রুপের কাজ থাকে। সেসব নিয়ে বিস্তর দৌঁড়ঝাপ দিতে হয়। তাই কয়েকদিন ধরে সেভাবে নেটেই বসা হয় না। রাতে কিছু সময়ের জন্যে বসে শুধু চোখ বুলিয়ে যাওয়া।

অনেক বিষয় আসে, সেসব নিয়ে পড়তে বা বলতে চাই, কিন্তু সময়ের কারণে তা কুলায় না। গত চার/ পাঁচদিনে সচলে এমন কয়েকটি বিষয় এসেছে, তা নিয়ে কথা বলার ছিলো। কিন্তু বলতে পারিনি।
ষষ্ঠ পাণ্ডব লিখেছেন, ব্লগে বা ভার্চুয়াল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা বা কারো কারো মতে লাফালাফি করা বিষয়ে। ব্লগ জীবনের শুরু থেকে এ বিষয়ে নসিহত পেয়ে আসছি। বন্ধুদেরকে, কমরেডদেরকে পেতে দেখেছি, আরো দেখবো, আরো উপদেশ পাবো সেটাই বলে রাখি। আমি মনে করি কান বন্ধ রেখে, নিজের কাজ করে যেতে হবে। মানে ব্লগে লাফাতে হবে। চিকা মারতে হবে, সময়মতো গদাম লাথিও মারতে হবে। শিকার করতে হবে। এবার আবার স্টিকার করবো আমরা। এ বিষয়ে কারো কোন উপদেশ (কেন এতো টাকা খরচ, কি হবে এসব করে... টাইপ) থাকলে দিতে পারেন। চোখ টিপি

স্টিকারের কথা যখন উঠলই তখন ফাঁকে এ নিয়ে কয়েকটা টুকরা ঘটনা বলি। আমার লেখার সাথে যারা টুকটাক পরিচিত তারাতো জানেনই আমি এক কথার ভেতরে আরেক কথা ঢুকিয়ে ফেলি। এটা তেমনই।
সচলদের করা স্টিকার নিয়ে এক বছরে নানান কাহিনী হয়েছে। গতমাসে সুন্দরবন থেকে ঢাকায় ফিরে বাস থেকে নেমেছি শ্যামলীতে। সেখানে বাস কাউন্টারে গিয়ে দেখি তার দরজায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই দাবী নিয়ে করা কালো হলুদ স্টিকারটা সাটানো। কি আরাম লেগেছে চিন্তা করেন। সুজনদার ডিজাইন করা স্টিকারটা ছাপানোর পরেই প্রেস থেকে প্রায় হাজার খানেক স্টিকার নিয়ে যায় আমার এক ছোট ভাই। জুয়েল ওর নাম। খুবি বিরক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু গত সাত আট মাসে আমার সেই বিরক্তিভাব কেটে গেছে। শহরে এই ক'মাসে যতো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হয়েছে সেখানেই গিয়েছে জুয়েল এবং অতি অবশ্যই স্টিকার বিলি করেছে। আজকে শহীদ মিনারের সামনে বিদ্যুতের খুটিতেও দেখি কয়েকটা সেটে রাখা। সম্ভবত জুয়েলেরই কাজ এটা। সেখানে লম্বা কালো হলুদ স্টিকারও দেখলাম দুইটা! কেমনে আসলো এক বছর পরে! গতরাতে শহীদ মিনারে যখন গেলাম, সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আফজাল ভাইর কাধে ঝুলানো ব্যাগে দেখি আনিস ভাই এর করা যুদ্ধ পাপীর শাস্তি চাই স্টিকার লাগানো। আমাকে দেখেই ব্যাগ দেখিয়ে বলেন, তোমার স্টিকার লাগানো আছে। তারপর ব্যাগ থেকে কয়েকটা স্টিকার বের করে কয়েকজনকে দিয়ে বল্লেন, শেষ। আরো দিও। বল্লাম, আবার ছাপা হোক পাবেন।

০২.
গত কয়েক বছরের মধ্যে এবারের মতো ভিড় দেখিনি। শহীদ মিনারে মধ্যরাতে মানুষের ঢল নেমেছিলো। দিনে দিনে নাট্যকর্মীর সংখ্যা কমছে। তাই ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। শান্ত রাতের কথা বলতে গিয়ে জুতা নিয়ে বলেছে। মারামারির কথা সে বলেনি। বেশ ধাক্কাধাক্কি হয়েছে। আর এবার সম্ভবত নিয়ন্ত্রনটা আগের মতো রাখা যায়নি। ধাক্কাধাক্কির কারণে বেদী থেকে কর্মীদেরকে দু'বার তুলে আনতে হয়েছে। সবচে বেশি সমস্যা করেছেন সংবাদ কর্মীরা। ফটুরে সাংবাদিকরা কাজের কোন শৃংখলাই মেনে চলে না এখন। এরা ভেজাল পাকায় বেশি। কালও পাকিয়েছে।

০৩
বিজয় দিবসের সকালটা এখন একটু দেরিতেই শুরু হয়। আগে মাঝরাতে ঘরে এসেও ভোরে আবার বেরিয়ে যেতাম। এখন বেরুতে বেরুতে দশ এগারোটা বেজে যায়। বাবাই মহা উৎসাহে আমাদের সাথে চললো। পতাকা আঁকা টি-শার্ট কিনে দেয়া হলো তাকে। হাতে পতাকাও তুলে দিতে হলো। খুব খুশি। মায়ের সাথে ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে গেলো ইউনিভার্সিটিতে। আমি একটু ঘুরলাম শহরে। তারপর গিয়ে জিন্দাবাজারে এক দোকানে বসে বসে আড্ডা পিটালাম গ্রুপের তিন বড় ভাইয়ের সাথে। কথা বলছি আমরা, এমন সময় সেখানে হাজির হলেন বাবাইর স্কুলের প্রিন্সিপাল। জামাত-শিবির বিজয় দিবসের মিছিল করেছে। সেটা নিয়ে তিনি উত্তেজিত। কি বলবো ঠিক ভেবে পেলাম না। মফস্বলের বোকা মানুষের মাঝে অধিকতর বোকা হন স্কুলের মাস্টাররা। আর সেই মাস্টার যদি মুক্তিযোদ্ধা হন, তাহলে তার মতো বোকা আর কে হতে পারে? ভদ্রলোক গলার রগ ফুলিয়ে সব দায় নিজেদের কাঁধে টেনে নিলেন। তাকে কি সব বলেছিলাম সে সময়। এখন সেসব মনে পড়ছে না, বা করতে চাইছি না।

বিকালে রিহার্সাল ছিলো। তাই বাবাইকে তার নানার বাসায় নিয়ে গেলাম। সকাল থেকেই খেয়াল করছিলাম, অনেক রঙিন হয়ে উঠেছে দিনটি। সম্ভবত আগে এমন ছিলো না। তুলিকে বল্লাম, সেও স্বীকার করলো কথাটা। নিজেদের মাঝে কথা বলে বের করলাম, দশ-বারো বছর বয়েসে আমরা যখন রাস্তায় নামতে শুরু করেছি তখনও বিজয়ের সাথে দগদগে হয়ে থাকতো স্বজন হারানোর ব্যাথা। উনচল্লিশ বছর পরে সেই বেদনাবোধ সম্ভবত আর নাই। আমার পরিবারে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এমন দিনগুলোতে তাদেরকে প্রায়ই হারিয়ে যাওয়া সহযোদ্ধা বা শহীদ স্বজনের কথা মনে করতে দেখেছি। এখন আর সেটা হয় না। দিনে দিনে বেদনাটুকু ঝরে পড়েছে, আনন্দটাই স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে। আমরা বিজয় দিবসকে একটা পার্বন বা উৎসবেই পরিণত করছি। এই দিনের জন্যে নতুন কাপড় কেনা হচ্ছে। আমাদের প্রদর্শক পত্রিকা এমনকি খাবারেরও ডেকোরেশন করে পতাকার ডিজাইনে।

শহীদ মিনারের পাশে আগে অস্থায়ী মঞ্চ বানিয়ে অনুষ্ঠান করা হতো। এখন সেখানে স্থায়ী মঞ্চ করা হয়েছে। সন্ধ্যায় সেই মঞ্চে যাবার জন্যে ভীড় ঠেলতে ঠেলতে মনে হলো বড়ো বেশি অপরিসর হয়ে গেছে আমাদের শহীদ মিনার চত্বর। আরেকটু বড়ো যায়গা নিয়ে, আরো খোলামেলা শহীদ মিনার আমরা পেতে পারতাম। কিন্তু হবে না। এ শহরে প্রান্তিকের চত্বরে দেয়াল তুলে টুকরা টুকরা করে দেয়া হয়। এ শহরে শিরিষ বৃক্ষ কেটে বিশাল মসজিদের একশ হাত দুরে সুরম্য মসজিদ নির্মিত হয়। এ শহরে শুধু শহীদ মিনারের জন্যে কোন উদার প্রান্তর মেলে না... এই গল্প কি শুধুই এই শহরের? নাকি পুরোটা দেশেরই গল্প এটা?

০৪
অনুষ্ঠান শেষ করে ভিড় ঠেলে রাস্তায় উঠে এলে বাবাই বায়না ধরে রেষ্টুরেন্টে খাবে। এটা নতুন শিখেছে। বাইরে আসলেই রেষ্টুরেন্টে যাবার বায়না ধরে। খাবারের জন্যে গিয়ে দেখি রেষ্টুরেন্টময় ছড়িয়ে আছে থোকা থোকা উৎসব! পরিচিত অনেককেই পাওয়া যায় সেখানে। বাবাইকে নিয়ে বসেছি রেষ্টুরেন্টের ভেতরে। হঠাৎ রেষ্টুরেন্ট এর উঠোন থেকে উঠে এলেন আমার এক মামা। বল্লেন, একটু বাইরে আসো। গেলাম। বল্লেন, মাইকের আওয়াজ শুনছো? শহীদ মিনার থেকে ভেসে আসছে বিজয়ের অনুষ্ঠানের শব্দ। হ্যা বলতেই বল্লেন, এইমাত্র জাতীয় সংগীত গাওয়া হলো। এখানকার সবাই সেটা শুনেছে, কেউ দাঁড়ায়নি, সম্মান দেখায়নি। এটা কি ঠিক? কোন উত্তর দিতে পারলাম না। তিনি বল্লেন, সম্ভবত এটা ঠিক না। অনেকে বুঝবেই না দুর থেকে ভেসে আসা সুরে শ্রদ্ধা জানাতে হবে কী না। মাইক বন্ধ করে জাতীয় সংগীত গাওয়া উচিত মনে হয় । একবার বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বল্লেন তিনি... এরপর থেকেই সেটা ভাবছি। আপনারা কি ভাবছেন বিষয়টা নিয়ে? একটু বলুন দেখি

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা