পাতা ঝরার আগের গল্প

জন্মের সময় ধুন্দুমার বাঁধিয়ে দিয়েছিলাম। মাকে নিয়ে জমে মানুষে টানাটানি। জম আর মায়ের মাঝখানে দাড়ালেন দুদু মই। নানা বাড়ির বুনিয়াদী ধাই। টেনে হিচড়ে বের করে নিয়ে আসা হল আমাকে। সাথে বেরিয়ে এল আরও কি সব যন্ত্রপাতি। মানুষ বানাবার কলঘরটা সেই থেকে নষ্ট। আমি বেড়ে উঠলাম অসুস্থ এক পরিবেশে। আম্মা কোন দিন আমারে শখ মিটায়া কোলে নিতে পারে নাই। বুঝতে শিখার পর থেকে আমি মা'র আশে পাশে ঘুরাফেরা করতাম। তার ঘ্রাণ নিতাম, কোলে চেপে বসতে চাইতাম। নেহার ফুপু আমাকে আগলে আগলে রাখতো। তাকে ফাঁকি দিতে পারলে মাঝে সাঝে মায়ের কোলে উঠা যেত। কিন্তু একটু লাফালাফি করে ফেল্লেই মা গলা ছাড়তো, ও নেহার কই গেলি, ময়না বাবুরে নিয়া যা।

মায়ের যেদিন শরীর বেশি খারাপ থকতো সেদিন খুব নিষ্ঠুরের মত বলতেন, নে'তো এই পান্ডারে। আমার জীবনটা নষ্ট করেও তার শখ মেটে নাই। এখন দরদ উঠা পেটে চাপ দেয় আবার। আমি মন খারাপ করে নেহার ফুপুর সাথে চলে যেতাম। পুকুর পাড় নয়ত পেয়ারা গাছের তলায় নিয়ে নেহার ফুপু আমারে মন ভুলানো কথা বলত। আমি সেইসব কথা শুনতে শুনতে কোন ফাঁকে মায়ের দেয়া কষ্টের কথা ভুলে যেতাম!

আমরা দু'ভাই বাজারের গলিতে গলিতে হাটতাম। স্কুল শেষে অথবা স্কুল ফাঁকি দিয়ে বাজারে হাটাই ছিল আমাদের রোজকার কাজ। রবিবার ছিল হাটবার। সেদিন বন্যার পানি এলে হাওর যেমন ফুলে যায় সেরকম বাজারও ফুলে যেত। ভীড় বাট্টার মাঝে আমরা হারিয়ে যেতাম, আবার ফিরে পেতাম নিজেদের, আবার হারাতাম...

শারিবাদি শালসার বিক্রি দেখতাম দাড়িয়ে দাড়িয়ে। হেন অসুখ নাই যা ভাল হয় না এই অব্যার্থ ওষুধ খেলে। লোকটার মনোহর বর্ণনা শুনে রোজ ভাবতাম পরের হাটবারে দশ টাকা জমা করে, নিয়ে আসব একটা বোতল। কত হাটবার যায়, আমার আর দশ টাকা হয় না। দুই ভাই মিলে ঝুলে একবার সাত টাকা জমাতে পেরেছিলাম। তারপর সারাদিন সেই ক্যানভাসারের দোকানের সামনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে তার বয়ান শুনেছি। দুপুরের দিকে যখন একটু ফাঁকা হলো সেই যায়গা, লোকজন খেতে গেল হয়ত। ক্যানভাসার লোকটাও উঠল। লাল টিনের বাক্সে তালা দিতে দিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে বল্ল, 'কিরে তোগো কোন কাম নাই? ইস্কুল নাই? কি করস এইখানে? 'আমার দু'ভাই অবলীলায় মিথ্যা বল্লাম। স্কুল নাই সেদিন। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, 'এই ওষুধ খাইলে পেটের বেদনা ভালা হয়?' লোকটা পাল্টা প্রশ্ন করে, 'তোর পেটে বেদনা? 'আমি বলি না, 'আমার মায়ের। 'কেমন একটা চোখ করে তাকায় সেই মানুষ। 'তোর মায়ের পেট কি ফোলা, অনেক মোটা হইছে? 'আমি মাথা নাড়ি। 'তাইলে? কয়দিন থাইকা বেদনা?'বড় ভাই কথা বলে, 'ওর জম্মের পর থাইকা আম্মার বেদনা'। লোকটা আবার কি যেন ভাবে। তারপর বলে, 'ওষুধ নিবি? 'আমরা দু'ভাই জমানো টাকা তুলে দেই তার হাতে। লাল বোতল নিয়ে যখন ঘুরে দাড়াই তখন আবার পেছন দিক থেকে ডাক শুনি। 'এই শুইনা যাও...' ময়লা পাঁচ টাকার নোট টা ফিরিয়ে দিয়ে সে বলে, 'নাও, খালি বোতলের দাম রাখলাম, তোমরা ছোট মানুষ। মা, ভাল হইলে আমার লাইগা দোয়া কইর। 'ঘোর লাগে আমাদের। আমরা ভুলে যাই পাঁচ টাকায় আল-আমিন কোম্পানির বিস্কুট পাওয়া যায়। দু'ভাই সামনে যেতে যেতে পেছনে ফিরে সেই লোকটাকে দেখি কয়েকবার।

আব্বা প্রথমেই ক্ষেপে যায় এইজন্য, যে সারদিন স্কুল ফাঁকি দিয়ে আমরা বাজারে ঘুরেছি। টাকা কোথায় পেলাম সে জন্যও সে ক্ষেপে। আর সবচে বেশি ক্ষেপে, বাজারে গিয়ে ক্যানভাসারদের কাছে বসে থাকি এটা জানতে পেরে। আম্মাও রাগ করে। নেহার ফুপুর হাতে বোতলটা দিয়ে বলে, এটা যেন সে রান্নাঘরের পেছনের দিকে ফেলে দেয়। আব্বা আমাদের পিঠে ইচ্ছেমতো বেত ভাঙ্গে। বেতের বাড়িতে আমি হউমাউ করে কাঁদি। ভাইয়া আমারে আগলাতে যায় আর আহ, উহ করে। নেহার ফুপু দুর থাইকা দাড়িয়ে দাড়িয়ে চোখ মুছে। সেই সময় বড় আপা স্কুল থেকে না ফিরলে, তার পাট কাঠির মত নরম হাতে আমাদের আগলে না ধরলে আর একি সময়ে আম্মার কান্না গলায় মিনতি না ঝরলে সেদিন আমাদের হয়ত মেরেই ফেলত আব্বা। পরদিন থেকে আমাদের আর স্কুল ফাঁকি দেয়া হয় না। আমরা আর বাজারের গলিতে হাটতে পারিনা। আমার সেই ওষুধের জন্য মন খারাপ করে। বার বার মনে হয়, ওষুধটা খেলে আম্মা হয়ত ভাল হয়ে যেতেন। ক্যানভাসার লোকটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করতো আমার।

নেহার ফুপুর বিয়ের রাতে হ্যাজাকের বাতি আনা হয় বাড়িতে। চারটা হ্যাজাক জ্বলে সবুজ কাপড়ে বাঁধা প্যান্ডেলের ভেতর। কালো কুচকুচে বরটা বার বার জিহ্বা দিয়ে তার ঠোট ভিজায় আর এই দিক সেই দিক তাকায়। মাঝে মাঝে চালের বস্তার ফাঁকে ইদুর যেমন মাথা বের করে, আবার ঢুকায়, সেরকম একটা ভাব যেনো। নেহার ফুপুর জামাইরে দেখে আমার শুধু ইদুরের কথা মনে হয়। আম্মা সেদিন নীল রঙের একটা শাড়ি পরেছিল। বড় আপা পরেছিল জরি বসানো একটা জামা। হ্যাজাকের আলোয় সেই জরি বার বার চকমক করছিল। আমার চোখ ঝলসে উঠেছে অনেকবার। সেই ঝলসানো চোখে আমি দেখেছি কবির ভাই বড় আপাকে টানতে টানতে দেউড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বড় আপা অস্বস্থিতে একবার বল্ল আহা, ছাড়তো, আমি আসছি, তুমি যাও...

ভোর রাতে আব্বা কোলে করে নিয়ে গেল আমাকে একেবারে সদর দরজা পর্যন্ত। নেহার ফুপু জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠে। আব্বা অনেক কষ্টে, এমনকি একটা ধমক দিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে বিদায় করে। লাল দাদা নেহার ফুপুরে পালকিতে তুলে দেয়। পালকি চলতে থাকলে, আমার চোখও ভিজে যায়। আব্বা আমারে বড় আপার কোলে দিয়ে উঠানের কাজে লেগে পড়ে।

ফুপু চলে গেলে পরে আমাদের বাড়িতে রোদ কেমন ম্রিয়মান হয়ে যায়। পুকুর পাড়ে কিংবা পেয়ারা তলায় আমার আর যাওয়া হয় না। বড় ভাই রোজ বিকালে ফুটবল খেলতে যায়। আমারে দু'একদিন যেতে বলেছে। যাইনি। এখন আর বলে না। আমি ঘরে বসে বসে মায়ের যন্ত্রনাক্লিষ্ট মুখ দেখি। বড় আপার সেলাই দেখি। সাদা রুমালে বড় আপা ছোট ছোট পাতার নকশা ফুটিয়ে তুলে। বিস্ময় নিয়ে আমি সেই কারুকাজ দেখি। কিন্তু রুমালটা তৈরি হয়ে গেলে আর খুঁজে পাই না। কোথায় সেটা লুকিয়ে ফেলে বড় আপা।

মাঝে মাঝে দুপুরের পর বেলাদি বেড়াতে আসে আমাদের বাড়ি। বেলাদি বেলি ফুলের তেল দেয় মাথায়। পাশে গেলেই সেই ঘ্রাণ পাওয়া যায়। ঘরে এলেই মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তার হাতটা কেমন তুলতুলে, নরম, মখমলের মত। বেলাদি এলে আমি তার পাশে পাশে ঘুর ঘুর করি। কিন্তু বেশি সময় থাকতে পারি না। বড়আপা বলবে, কিরে তুই আমাদের মাঝে কি করিস? যা এখান থেকে, খেলতে যা। আমি বলি, একা যাব কীভাবে? বড়ভাইতো চলে গেছে। বেলাদি বলে, কেনরে, সজল তোকে নেয়না সাথে? আমি মিথ্যে মিথ্যে মাথা নাড়ি। আপা ধমক দেয়, আরে রাখ, এই ছেলে ঘরকুনো, যেতেই চায় না। এই যা ভাগ, মায়ের কাছে যা। আমার মাথায় ঢুকে না, কি এমন কথা আছে তাদের যা আমি শুনতে পারব না? বেলাদি আমায় বলে, তুই বিকেলে আমাদের বাড়িতে আসিস। কনক, রাজুদের সাথে খেলবি।

বেলাদির মাথায় একরাশ ঘনকালো চুল । রাজ্যের বিস্ময় মাখানো একজোড়া চোখ ছিল তার। তখন অবশ্য অতটা বুঝতামনা। শুধু চোখ গুলো দেখতে আমার ভিষন ভালো লাগত।

আমাদের বাড়ির উত্তর সীমানায় ছিল একসারি কদম গাছ। তার পরই শুরু বেলাদিদের বাড়ি। সীমানা থেকে ঘর অবধি যেতে বেশ লম্বা একটা ফাঁকা যায়গা ছিল। মখমলের মত বিছানো সবুজ সবুজ সেই ঘাসের মাঝখানে ছিল বেশ বড় একটা পাথর। অনেকটা বেদীর মত। সাদা রঙের সেই পাথরে বসে রোজ বিকেলে বেলাদি রবীন্দ্রনাথের বই পড়ত। মাঝে মাঝে সুনীল।
আমরা সব বালকের দল সেই ফাঁকা যায়গায় খেলা করতাম। গোল্ল্লাছুট খেলা হত। পাথরের সেই বেদীটাকে কেন্দ্র ধরে আমরা ঘুরে ঘুরে ছড়া বলে একসময় দিতাম ভু দৌড়। আমরা আসলে বেলাদিকে ঘিরেই ছড়া কাটতাম।

ওই বয়েসে আমরাতো আর দুরে কোথাও যেতে পারতামনা। তবে আস্তে আস্তে আমাদের দৌড় বড় হতে থাকে। বেলাদিকে ঘিরে ছড়া বলার সময় ফুরুতে থাকে। গ্রামের শেষে যে মাঠ, তারও পরে যে পরিত্যাক্ত জমিদার বাড়ি। সেইসব গলিঘুপচিতে ভাগ হতে থাকে আমাদের শৈশব।

কনক, নিলু, রাজু সবাই খুব সহজেই রোজ রোজ চলে যেত সেইসব অচেনাকে চিনতে। আমার যাওয়া হতনা। কি এক পিছুটানে আমি রোজ বেলাদির উঠোনে ঘুর ঘুর করতাম। আমার শুধু মনে হত আবার আমার বন্ধুরাসব ফিরে আসুক সবুজ এই মখমলে। আমরা লোকুচুরি খেলায় মাতি। হাতের বইটা পাশে রেখে বেলাদি আমাদের মাঝে যে চোর হল তার চোখটা চেপে ধরুক। (হাতের ছোঁয়া পাব বলে আমিই হতাম নিয়মিত চোর।) অথবা আমরা তাকে ঘিরে আবার ছড়া আউড়াতে থাকি। কেউ সে মনোডাকে সাড়া দেয়না! আমি থাকি সেই ছোট্ট মাঠে।

আমাকে ঘুরতে দেখে বেলাদি মাঝে মাঝে বলে, কিরে তোর খেলা নাই? আমি মাথা নাড়ি। বেলাদি হাসে। মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকি। হাত ইশারায় কাছে ডাকে বেলাদি। আস্তে আস্তে এগিয়ে যাই। মাথার চুলগুলো বিন্যস্ত করতে করতে বেলাদি বলে, যা খেলতে যা। সন্ধায় ঘরে যাওয়ার সময় আমাকে দেখে যাবি!

আমি দৌড় দিই। বেলাদি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই আমি আতরের ঘ্রান পেয়েছি। সেই ঘ্রানটা সঙ্গি করে আমি দৌড়াই।
(এই লেখার অংশ বিশেষ কারো কারো পড়া থাকতে পারে। সচলে আমার ব্লগের প্রথম দিকে তোলা আছে। বাকিটা নতুন। ইদানিঙ লিখতে পারি না। হাপিয়ে উঠি। অভিমান করে পালিয়ে যাওয়া শব্দদেরকে বশ মানানোর চেষ্টা করছি।)

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা