পুনর্বার কয়েক টুকরো দিন যাপনের গল্প...

পানি বাড়ছে রোজ। সকালে একবার করে নদীর পারে যাই। পানি দেখি, হু হু করে বাড়ছে। রোজ বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি ছাড়া কোন ২৪ ঘন্টা পাচ্ছি না। কোন কারণে দিনে রোদ দিতে হবেই এমনটা হলে, সকালটা ভিজিয়ে যাচ্ছে! আর সারাদিনের রোদ এর শোধ তুলে রাতে। আমার সবচে প্রিয় বাহন মোটর সাইকেল। ১৬ বছর ধরে টানা চালাচ্ছি। তবু শখ মেটে না। বৃষ্টির কারণে এটা চালাতে পারছি না। দারা-পুত্র নিয়ে চলতে হয়, আমার ভেজার শখ তাদের উপর দিয়ে চালালেতো হবে না। তাই বাক্সোবন্দি হয়ে চলাফেরা করি।

প্রায় তিনটা মাস ধরে মহা বিশ্রি এবং বাজেভাবে সময় কাটাচ্ছি। আব্বা আম্মা দুজনেই দেশের বাইরে, বাড়িটা পাহারা দিয়ে রাখতে হচ্ছে। সন্ধ্যা হলো, হাস মুরগি ঘরে তোলো, এই বাক্যের সাথে নিজেরে মিলিয়ে দিতে হয়েছে এতদিন। তার উপর রোজ বাবাইকে তার নানার বাসায় রেখে আসতে হয়েছে সকালে, আবার বিকালে নিয়ে আসো। এজন্যই মূলত নদীর সাথে নতুন করে প্রেম প্রেম একটা ভাব হয়েছে।

আমি নদীবর্তী মানুষ। হাওর-নদীর জলজ পরিবেশ ও প্রকৃতিকে সঙ্গী করে বড়ো হয়েছি। নাগরিক হয়ে উঠিনি তবু নগরেই থাকি, তাই এখন জলের গভীরে আর যেতে পারি না। বৃহস্পতিবারে সুরমা পাড়ি দিতে হলো। ক্বীন ব্রিজের উপর থেকে দেখলাম খেয়া নৌকা। কালিঘাটের দিকে ভিড়ছে। যেখানে ভিড়ছে সেই যায়গাটা চিনি। কিসমত ট্রেডার্সের বারান্দা সেটা। আমাদের অসংখ্য পাগলামির সাক্ষি এই কিসমত ট্রেডার্স। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ফেরার সময় খেয়া নৌকায় নদী পাড়ি দেবো।

বাজারে এখন এক টাকার কয়েনের আকাল। টাকার বদলে দোকানদার চকলেট ধরিয়ে দেয়। পকেট ভর্তি হয়ে যায় কোন কোন দিন। আশ্চর্য বিষয় হলো, দোকানিরা আপনাকে চকলেট ধরিয়ে দিচ্ছে ঠিকই। কিন্তু আপনি দিতে গেলে সেটা কিন্তু রাখছে না! এ নিয়ে কয়েক দফা ঝগড়া করে ফেলেছি। আমি দরবারী (ঝগড়াটে) মানুষ, তাই লোকজনে বেশি পাত্তা দেয় নাই। খেয়া নৌকায় উঠে দেখি সেখানে বিস্তর ভাংতি পয়সা। আট আনা (পঞ্চাশ পয়সা) দিতে হয় নৌকায়, ঘাটে আরো আট আনা। টাকা দিলে সিলমারা টোকেনও দিচ্ছে! এই ভরা সুরমা এক টাকায় পারাপার! এতো সস্তা হলোতো বেশি বেশি হয়ে যায়।

সুরমার পানি এখনও বেশ ভালো। শীতের সময় পানিপ্রবাহ কমে গেলে সেখানে অনেক ময়লা দেখা যায়। তবে এখনতো ভরাট যৌবন। বাজি ধরে এই নদী সাতরে পাড়ি দিয়েছি। দশ টাকার জন্যে হাতের মুঠোয় নিয়েছি জীবন! লাখ টাকাতেও কি এখন এই মোটা পেট নিয়ে সেই সাহস দেখাবো? মনে হয় না। সাথে থাকা এক ছোটভাই ক্যাট ক্যাট করে সেটাই বুঝিয়ে দিলো। নৌকা ডুবার চান্স নাই। তবু বলে, পড়ে টড়ে গেলে সাতার দিয়েন না। যাস্ট ভেসে থাকবেন, তাইলেই তীরে পৌছে যাবেন। বেটারে আর বলা হয় না, নলুয়ার হাওরে সাতার শিখেছিরে বেটা, আর ১৭/১৮ বছর আগে এই নদী আরো অনেক বেশি চওড়া ছিলো...

টুকুদা আমাকে দেখে বেশ অবাক। নদীর দিক থেকে এসেছি বলে। আগের কিছুই নেই আর। একা একা বসে আছেন, ব্যবসা নাকি নাই। ঘর ভর্তি পেয়াজ রসুনের বস্তা পড়ে আছে, ক্রেতা নাই। পানি বাড়ার কারণে লোকজন আসছে না। তাই পাইকারি বাজারের এই দশা। এই গদিতে বসে দিনের পর দিন আমরা আড্ডাবাজি করেছি। ঢাকা হোটেল থেকে ভাত আসতো। তারপর শুরু হতো ভয়ঙ্কর খানাদানা। আমার জীবনে এমন নিয়মিত খাদকাড্ডা আর কখনো দেখতে পাবোনা সম্ভবত। আট বছর আগে নাকি ঢাকা হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে! এর মানে কি? গত আট বছর আমি বেখবর হয়ে আছি! হায় সময়! কিভাবে সম্ভব হয় এসব?


২.

সিনেমা দেখা আমার তেমন হয় না। টিভিও না। মাঝে মাঝে খবর দেখি, কিন্তু ছেলের সাথে যুদ্ধে বেশিক্ষণ টিকতে পারি না। নেটস্পিডও ইদানিং এতো কম পাই, পংকি ভাইর দোকান কিংবা রিহার্সাল কিছুতেই যাওয়া হয় না। তুলি প্রায় প্রতিদিন একটা করে সিনেমা নিয়ে আসে। বসে বসে সেটা দেখি। আমার সিনেমা দেখার তরিকাতে সমস্যা আছে। একটা সিনেমা অসঙখ্যবার দেখি। একেবারে ছ্যাবড়া বানিয়ে ফেলি মাঝে মাঝে। বাবাই নিজেও এই পদ্ধতি পছন্দ করে। মুন্নাভাই সিনেমাটা তার ভালো লাগলো, শুরু হলো দেখা। রোজ রোজ দেখা হচ্ছে বলে আমি গুনতে শুরু করলাম, ৭০/৮০ বার গুনার পর বাদ দিয়েছিলাম। অবস্থা এমন হলো যে, দৃশ্য আসার আগেই বাবাই সেটা বলে দিচ্ছে, আমিও বলে দিতে পারি! জ্যাকি চ্যান এর একটা সিনেমা সম্ভবত ফরবিডেন কিংডম। বাবাই এটা দেখেই চলেছে, থামছে না। ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে থ্রি ইডিয়টস। এখনও চলছে। আমার ভাতিজাকে ভাত খাওয়ানোর সময় এটা ছাড়তে হয়! হি ইজ সিমলা এই একটা দৃশ্য এতোবার টানা হ্যাচড়া হয়েছে তার জন্যে যে, সিডিতে সম্ভবত স্ক্রেচ পড়ে গেছে। এখন সে আমার উপর হামলা করে। হার্ড ডিস্কে রাখা আছে, সেটা সে দেখে, আর কিবোর্ডের উপর খিচুড়ির বন্যা বইয়ে দেবে। এতবার দেখলে যেটা হয়, নানান ছোটখাটো ভুল চোখে পড়ে, সিনেমাটায় দশ বছর আগের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু এরা দেখা যায় ক্যানভাসের জুতা পরে ঘুরে। ক্যানভাসের জুতা পরার ফ্যাশনতো তখন ছিলো না। তার উপর আবার দশ বছর পরে রাজু সেই একি রকমের জুতা পরছে। তিন বন্ধু নানান আকাম করে পানির ট্যাংকির উপর। সেটা প্রথম থেকেই ছিলো। কিন্তু চতুর যেদিন বাজি ধরলো আমিরের সাথে, সেদিন দেখালো পানির ট্যাংকির কাচা সিমেন্ট। সেই সিমেন্ট এ দাগ কেটে তারিখ লিখলো চতুর। ক্যামনে কি? দাদাভাই অবশ্য বলছে, তখন পানির ট্যাংকির সংস্কারের কাজ চলছিল। তারপর সুহাসের মতো একটা প্রাইজট্যাগ টাইপ লোক দশ বছর বসে থাকবে নায়িকার জন্যে, একিন হয় না। তবু এদের অভিনয়, এক কথায় অসাধারণ। ছোটখাটো দৃশ্যগুলো্ও চিন্তা করে তৈরি করে বলেই মনে হয়। রাজুর বউ ব্যায়াম করছে, সে প্যান্ট ছাড়াই বাইরে যাচ্ছে, একটা ছোট দৃশ্য, কয়েক সেকেন্ড এর মামলা, তারপরও কতো মন দিয়ে কাজটা করলো। ভাইরাস বক্তব্য দিচ্ছে, সেটা কপি করছে মিলিমিটার, তার হাতের ফাঁক দিয়ে আউট অব ফোকাসে দেখা যাচ্ছে ভাইরাস হাত নাড়ছে। কিঙবা আমির খান নিজের ক্লাস থেকে বেরিয়ে অন্য ক্লাসে গিয়ে যখন ঢুকলো, তখন সেটা খেয়াল করে সিনিয়ারদের চোখাছোখি, কত যত্ন থাকলে এসব করা যায়। আমাদের সিনেমাওয়ালারা এসব যদি করতো।

হিন্দি বুঝিনা। চে এর সাথে বে মিলিয়ে ধরে নেয়া টাইপ বুঝদারি ছিলো। এখন সেটা একটু উন্নত হয়েছে। তবু সবতো আর বুঝি না। থ্রি ইডিয়টস এর গানগুলো ভয়ংকর মনে ধরছে। প্রথম গানটা শুনেতো আমি পাংখা। ভাবলাম বাতাসে উড়ে যাওয়া পাতার কথা বলতেছে, পরে শুনি এই পাতাং পাতা নয়, এইটা বুঝি ঘুড়ি। তবে বাবাইর এতসব জানার দরকার নাই। সে নিজের মতো করে গান বুঝে নিচ্ছে। যেমন জুবিডুবি জুবিডুবি টাইপ একটা গান আছে আমির কারিনার। সেটা দেখে সে নিজেও গাইতে শুরু করলো। সেই গানের একটা লাইন শুনে আমি বিমোহিত, .... রামপাপা, পাগল সুলেমান...


৩.

আলমগীর মাস্টার দেশে আসছেন। পাশের বাড়িতেই থাকেন বলা চলে, কিন্তু ব্যাপক ঘরকুনো মানুষ। এরসাথে হবে না এইটা বুঝে গেছি। তারে বাইর করতে দড়ি দিয়ে টানতে হবে সম্ভবত। সেই হিসাবে আমাদের বুড়াভাই জোসসসসস। ১১ তারিখে তার সিলেটে আসার কথা। শুক্রবার। বেশ রোদ টোদ আছে। আমি হিসাব করে দেখলাম, বুড়াবেডা বারোটার দিকে সিলেটে আসবে। দিলাম ফোন, কোথায় আছে সেটা জানতে। ওমা সে দেখি আরো দুই ঘন্টা আগেই সিলেটে পৌছে গেছে! সাড়ে তিন ঘন্টায় এই লম্বা রাস্তা পাড়ি দিয়েছে। আল্লাহ তুমি এই জিনিসরে হেফাজতে রাখো। উজানগাঁ ছিলো তার সাথে। আরো যোগ হলো মোনায়েম ভাই, সিলেটের প্রিয়মুখ এই ফটুয়াল। আরেকজন ছবিয়াল আতাও যোগ দিলেন আমাদের সাথে। তারপর চলো জাফলং...

জাফলং নামের অতি রূপবতী এলাকাটারে আমরা ইচ্ছামতো খাচ্ছি। যতভাবে খাওয়া যায় ততভাবেই খাচ্ছি। ছোটবেলায় যে জাফলং দেখেছিলাম, এখন তার ১০ ভাগও নাই। তবু ভালো লাগে জায়গাটারে। বছরে কয়েকবার যাই। প্রায় নিয়মিত। এমন যাওয়ায় যেটা হয়, প্রকৃতির বদলে যাওয়াটা সেভাবে আলাদা করে ধরা পড়ে না। কিন্তু জাফলংরে এমন উথাল পাথালভাবে এরা ধর্ষণ করছে যে, প্রতিবার গিয়েই দেখি আরো ব্রিশ্রি হচ্ছে, আরো বেশি শ্রীহীন হচ্ছে। তবু ভালো লাগে, আমি বার বার জাফলং এ ফিরে যাই, আর ওপারের বিন্যস্থ পাহাড়-ঝর্ণা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, বলি- সমৃদ্ধির শেষ যেখানে, সেখান থেকেই তোমার শুরু প্রিয় বাংলাদেশ।

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা