আমাদের গল্প আর এ সংক্রান্ত বিষণ্নতা


মা শৈশবে খুব দুরন্ত ছিল। তার দুরন্তপনার নানান গল্প ছড়িয়ে আছে গ্রামে। নানিজীর মুখে সেসব শুনেছি আমরা। গ্রামের বড়রা গল্প করতো, মা নিজেও বলে। অন্যদের মুখে শোনার চেয়ে মায়ের নিজের বলাটা শুনতে বেশি ভালো লাগে। তার গল্প বলার এমন চমৎকার ভঙ্গি, এমন জমিয়ে গল্প করে, আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার শৈশব গিলতে থাকি। দম ফাটানো হাসি, রুমাঞ্চ কিংবা কান্নার গল্পগুলো। মা খুব বুদ্ধিমান, কোন গল্পটা শুনলে আমাদের মন খারাপ হয়, কোনটা শুনলে মজা পাই এটা বুঝতে পারে। তাই মজাদার সব গল্পই আমাদের বলে।

আমার মা খুব মেধাবী। তার সাথে যারা পড়তো, এই এত্তোবছর পরেও আমাদেরকে দেখলে সেই কবেকার স্কুলের গল্প বলে। মায়ের অসম্ভব মেধার বয়ান শুনি তাদের কাছে। তখনকার বিজাতীয় জাতীয় সংগীত গ্রামের কোন শিশুই ভালো করে শিখতে পারতো না। মা নাকি সেটা মুখস্ত করে ফেলেছিলো। রোজ সকালে পতাকার সামনে দাড়িয়ে সেই গান গাইতো মা, আর তাতে গলা মেলাতো স্কুলের অন্যরা।

নানাবাড়ি আয়তনে বিশাল। বাড়ির এ মাথা থেকে ও মাথা দেখা যায় না। ইচ্ছে করলে নানাজান একটা স্টেডিয়াম বানাতে পারবে। সেই বাড়িতে, মা-মামারা যখন ছোট তখন অনেক গরু ছিলো। হাস-মুরগ ভর্তি ছিলো সে বাড়ীতে। এর মধ্যে মায়ের মালিকানা ছিলো শুধু ছাগলে। মালিকানা দেখানোর জন্য নানান কাণ্ড করতো সে। সকালে হয়তো, বাড়ির কাজের লোক ছাগল মাঠে নিচ্ছে, মা সেখানে হাজির হয়ে বলবে, আজকে অনেক রোদ উঠবে, মাঠে গেলে ছাগলের কষ্ট হবে। এদেরকে আজ বের করা যাবে না। বাড়ির পুরনো লোকটা জানতো কিভাবে মেঝো আম্মাকে বসে আনতে হয়। সে সাথে সাথে নির্দেশ মেনে নিতো। পরে, মা যখন স্কুলে চলে যেতো, তখন কাজটা করে ফেলতো। কিন্তু অন্য যারা ছিলো, বিশেষত নতুন কেউ আসলে প্রথম প্রথম এসব ধরতে পারতো না, তাই সমস্যা পাকিয়ে ফেলতো। যেমন, এক সকালে ছাগল আটকে রাখার ইচ্ছে হলো তার। সেদিন নতুন একজনের দায়িত্ব পড়েছে ছাগল মাঠে নিয়ে যাবার। পুচকে একটা মেয়ের কথা শুনতে সে প্রস্তুত না। তাছাড়া সকাল সাতটায় দুপুরে অনেক রোদ হবে এটা কেমনে বুঝলো এই পুচকা। সে বলে, জিনা মেঝো আম্মা, ছাগলরে বাড়িতে রাখা যাবে না, মাঠে না গেলে এরা ঘাস খেতে পারবে না। তখন গোস্ত কমে যাবে। সাথে সাথে উত্তর, তুমি ছাগলের জন্যে ঘাস কেটে নিয়ে আসো। লোকটা ভাবে এতো মহা মুসিবত, সে বলে, আম্মা, ছাগলতো কাটা ঘাস খায় না। কাটা ঘাসতো গরুর জন্য আনা হয়... কে শুনে কার কথা? নিজেই ঘাস কাটতে চলে যায়  আম্মা! এ কথা বলেই আম্মা তার বাম হাতের তর্জনিটা তুলে দেখায়, এই দেখ কাটা আঙ্গুল, সেদিন ঘাস কাটতে গিয়ে এটা কেটেছিলাম!

মায়ের আরো দস্যিপনা ছিলো। সে গাছে গাছে চড়ে বেড়াতো সবসময়। গ্রামের কোন বাড়িতে আম পাকলো, কোন বাড়ির কাঠাল বেশি মিস্টি এটা মায়ের মুখস্ত ছিলো। নানী বলেন, গাছের নিচে কাঠালের বিচি পাওয়া যেতো, কোন ফাঁকে দস্যি মেয়ে গাছে চড়েছে আর কাঠাল সাবাড় করেছে, কেউ টেরই পেতো না।

বর্ষার শুরুতে, হাওরে যখন পানি আসতো তখন সবাই রাতে শিকার করতে বেরুতো। মাছ শিকারে। কেউ হাওরের পাড়ে পাড়ে ঘুরতো চোঙা বাতি হাতে। ছোট ছোট জিয়ল মাছ ধরতো ওরা। মা নাকি প্রায়ই ছোট মামাকে নিয়ে মাছ ধরতে চলে যেতো। মা এসব গল্প বলে হাসতে হাসতে, আর নানী এই গল্পগুলো বলার সময় ভয় ভয় মুখ করে থাকেন। যেনো সেই সময়েই ফিরে গেছেন তিনি।

বাড়িতে আমরা যখন একসাথে বসি, হয়তো খেলা দেখছি, অথবা নাস্তা করছি, গল্পের মাঝখানে এই গল্প ঢুকে যায়। মা তার কিশোরীবেলার গল্প বলেন, আমরা শুনতে থাকি। বাবাও মুগ্ধ হয়ে সেইসব গল্প শুনে। মা বলতেই থাকে, বলতেই থাকে। সেইসব গল্পের সাথে আমরা নিজেদের গল্প মেলাই।

রুমঝুম মাঝে মাঝে বাবার শৈশবের গল্প শুনতে চায়। বাবা কেমন বিব্রত হয় ওতে। বোকার মতো হাসতে থাকে। হাত দিয়ে মাছি তাড়াবার মতো করে বলে, ধুর আমার ওসব মনে নাই, তোদের মায়ের মতো গল্প বলার ক্ষমতাও আমার নাই। আমি বা মা এসময় কথা বলি না। মা হয়তো অন্য কোন গল্প শুরু করে রুমঝুম এর মনোযোগ ফিরিয়ে নেয়। বাবা বিষণ্ন হয়ে বসে থাকে, নয়তো উঠে যায়।

বাবার শৈশবের কোন গল্প নেই। বাবা অনাথ ছিলো। বাবা এতিমখানায় বড় হয়েছে।

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা