গল্প সংক্রান্ত অভিমান


বাবা অসম্ভব মজা করে কথা বলে। যে শুনে সেই হাসে। হাসতে হাসতে পেট ফুলে যায়। আমাদের বাড়িতে যেই আসে সেই বলে, বাবার মতো মজার মানুষ কোনদিন সে দেখেনি। বাবা এতো চমৎকার সব কৌতুক জানে, মুখ এমন ভেংচি কাটতে পারে, না দেখলে না শুনলে কেউ সেটা বিশ্বাস করবে না কিংবা বুঝতে পারবে না।

বাবার অনেক রাগ, সেটা কিন্তু কেউ তেমনভাবে বুঝে না। আমরা বুঝি, বড় চাচা বুঝে। আমার এখন বাইশ বছর বয়েস, বন্ধু ছাড়ারই সাহস নেই, কিন্তু বাবা সেই বাইশ বছর বয়েসে ঘর ছেড়েছে, আর যায়নি। চাচার সাথে কক্ষনো কথা বলেনি। চাচা প্রতি বছর রুটিন করে দু'বার আমাদের দেখতে আসে, কান্নাকাটি করে, বাবা সেটা আমলেও নেয়না। বাবা আর কোনদিন বাড়ি যাবে না। কী তীব্র অভিমান!

ছোটবেলা থেকে সবাই বলে আমি নাকি বাবার মতো। আসলেও তাই। বাবা মাত্র সাড়ে পাঁচ ফুটি একটা মানুষ। আমিও তাই। বাবা দেখতে মোটামতো, আমিও তাই। তবে লোকজন এসব কারনে আমাদের বাপ বেটার মিল খুজে না। তারা আমার মজা করে কথা বলার ক্ষমতাটার কথা বলে। আমি এটা ঠিক জানি না, বুঝি না বা সচেতনভাবেও করি না। এম্নিতেই আমার কথা কিরকম মজা মজা হয়ে যায়। এক দিক দিয়ে আমি বাবার চে এগিয়ে। শরীর দুলিয়ে, গলা মিলিয়ে আমি নানান অভিব্যক্তি করতে পারি। অবিকল না হোক মোটামোটি কাছাকাছি নকল করতে পারি যে কাউকে। সেটা সম্ভবত অনেক উপভোগ্য হয়। আমি দেখেছি লোকজন আমাকে এ ওর বিরুদ্ধে উসকে দেয়, চেষ্টা করে নকলামি দেখতে। ক্রিকেট খেলা হোক বা না হোক, আমাকে ক্রিকেটের ধারাভাষ্য দিতেই হয়! হরতাল না হলেও বিটিভির হরতালের খবর পড়ে শোনাতে হয়। আমর মজাই লাগে।

এম্নিতে আমাদের কোন অনুষ্ঠান থাকলে বাড়ির কিংবা বন্ধুদের, জমানো কিছু করতে হলে সবাই আমাকে মনে করে। আর কিভাবে কিভাবে যেনো আমি জমিয়েও তুলি আসর। এইতো সেদিন নাচের অনুষ্ঠানটায় যেতে পারলাম না। কাজ ছিলো। অনুষ্ঠান শেষ হতেই ফোন আর ফোন। এ একবার তো সে একবার। ভাংগা অনুষ্ঠানে গেলাম। জুইকে নিয়ে একটার পর একটা ফাজলামি করলাম। সে চেয়ারে বসে বসে হাসতেই থাকলো। নড়তে চড়তে পারে না। পেটে হাত দিয়ে বলে, ওই তুব থামবি! আমারতো ব্যাথা শুরু হয়ে যাচ্ছে... আমি দৌড়ে দরোজায় চলে এলাম, তরপর থেমে বল্লাম, নারে বাবা আর থাকা যাবে না, শহরের সব লেডি ডাক্তার ক্ষেপে যাবে। এভাবে অপারেশন ছাড়া বাচ্চা পয়দা হতে থাকলে তারা আমারে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে দেবে! মোটর সাইকেল স্টার্ট দিতে দিতে আমি শুনি, ভেতরে হাসির চোটে গমগম করছে, সবকিছু উড়ে যাচ্ছে।

আমাদের নাটকের দলে বাঘা বাঘা সব অভিনেতা। এরা মানুষকে হাসায়, কাঁদায়, রাগায়। একবার একটা নাটকে আমাকে দেয়া হলো ভাড়ের চরিত্রটা। নাটকের শুরু থেকে শেষ অব্দি নেচে গেয়ে ধুন্দুমার বাধিয়ে দিলাম। ডিরেক্টর বল্লেন ওরতো অভিনয় করতে হয়নি, ন্যাচারাল, একেবারে চাচার সবকিছু পেয়েছে। হয়তো সত্যি, কিন্তু আমি আসলে অভিনয়টা মন দিয়েই করেছি, সবচে বেশি রিহার্সাল করেছি আমি, নাটকটা নিয়ে আর সবার চেয়ে বেশি ভেবে থাকলে সেও আমিই ভেবেছি। এর পরের নাটকটাতে আমার একটা ছোট্ট চরিত্র। মিনিট কয়েক। খুব কষ্টের সেটা। রিহার্সালে মোটামোটি চালিয়ে নিলাম। সবাই বল্ল এতেই চলবে। যেদিন নাটক হলো, সেদিন জানি না কি হলো আমার, এর আগে একদিনও রিহার্সেলে যা হয়নি, সেদিন না চাইতেই সেটা হয়ে গেল। আমার চোখ দিয়ে কখন কিভাবে টপ টপ করে পানি আসলো সেটা নিজেই জানি না। নাটক শেষ হবার পরও আমি কাঁদছিলাম। কিন্তু নাটক শেষে গ্রুপের মূল্যায়ন সভায় বিষয়টা সবাই বেমালুম এড়িয়ে গেলো। একজন বরং বল্লেন, আগের নাটকে দীর্ঘ ভাড়ের চরিত্রটা আমার ভুলে যাওয়া উচিত, তাহলে এই নাটকে আরো ভালো কাজ করতে পারবো।

ভাড় তকমাটা লেগে গেলে মানুষের এমনই হয়। সবাই ভাবে এরে দিয়ে সিরিয়াস কিছু হবে না। সবাই ভাবে এর ভেতর কোন রাগ নেই, কোন অভিমান নেই। এর ভেতর জেদ বলতে কিছু নেই। মানুষটা খুবি সহজ, জলের মতো। হয়তো তাই। সবাইতো আর বাবাকে ভালো করে চিনে না। আমি জানি আমার বাবাকে, তাই জানি এই যাওটাই শেষ যাওয়া, আমি আর দেশে ফিরবো না। কোনদিন না...

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা