অপার্থিব জানালার খোঁজে


তখন আমাদের কেরানির জীবন। বাবা পোস্টমাস্টার। কিন্তু আদতে সেটা কেরানিরই চাকরী। ভাই ঢাকায় একটা হাউজিং কোম্পানিতে জুনিয়র এক্সিকিউটিভ। আজকাল সব অফিসে সবাই এক্সিকিউটিভ হয়। গালভরা নাম সব। আদতে সবাই কেরানি। আমি নতুন চাকরীতে। পত্রিকার ডেস্কে বসি, তাও এক ধরনের কেরানিরই কাজ। বাপ ছেলে তিনজন যখন কেরানিরই চাকরী করি তখন সেটারে কেরনির জীবন বলাটাই উচিত।

আব্বা শহর থেকে ১৫/১৬ কি. মি. দুরের একটা ছোট্ট পোস্ট অফিসে কাজ করেন তখন। চাকরীর শেষ ১৫ টা বছর তিনি শহরেই ছিলেন বেশিরভাগ সময়। মাঝখানে কিছুদিন বাইরের ছোট ছোট দুটি অফিসে কিছুদিন ছিলেন। বড় অফিসে যেতে চাইতেন না। কাজের চাপে হাপিয়ে উঠতেন। শহরের সবচে কাছের দুই ছোট অফিসে তাই থাকা।

ছোট্ট একটা বাজারের অফিস। টিনশেড একটা বাড়ি। সাকুল্যে তিন জন স্টাফ সেখানে। অফিসের সামনের দিকটায় পাকা সড়ক। আর পেছনে রেল লাইন। সিলেটে আসা কিংবা সিলেট থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলো যখন ঝম ঝম শব্দে পাড়ি দিতো সেই বাজার, পুরনো বাড়িটা তখন যেনো কেঁপে উঠতো।

আব্বা অফিস ছাড়া কিছু বুঝতেন না। ঝড়-বাদল, হরতাল কিছুই তাকে আটকে রাখতে পারতো না। চাকরী জীবনের বেশিরভাগ সময় বাড়ি আর অফিস এক কম্পাউন্ডে থাকায় এটা বুঝতে পারিনি। কিন্তু যখন সিলেটে চলে এলাম উপজেলা সদরের পাট চুকিয়ে, তখন তার এই বিষয়টা ধরা পড়লো। হরতাল হলেই মোটর সাইকেল চালিয়ে দিয়ে আবার নিয়ে আসতে হতো। আব্বাকে নিয়ে মোটর সাইকেলে বসা বেশ একটা ঝক্কির। পেছন থেকে অনবরত ইনস্ট্রাকশন দেয়া। সামনে কিছু পড়লো, পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যাবে, কিন্তু পেছন থেকে শিশুর মতো ঝাপটে ধরা। ব্রেক না করে উপায় নেই। তবুতো আমার কপাল ভালো। দাদাভাই যখন এরকম দিনে আব্বাকে নিয়ে যেতো, তখন তিনি এমনকি দাড়িয়েও যেতেন সমস্যা মনে হলে। একবার সামনে একটা গরু পড়েছিলো। দাদাভাই ব্রেক ধরেছে। আর আব্বা পেছনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। একেতো ব্রেক ধরা হয়েছে, তার উপর পেছন থেকে আব্বা দাড়িয়ে পড়ায় মোটর সাইকেল হঠাৎ পাতলা হয়ে ছিটকে পড়লো দাদাভাই সমেত! এরপর থেকে আর দাড়ানোর মতো বোকামী করেন নি। অবশ্য ড্রাইভার হিসেনে আব্বার আমাকে বেশি পছন্দ। কোথাও যেতে হলে গাড়ির চেয়ে আমার মোটর সাইকেলে চড়তেই স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন।

ঢাকা যাবার জন্য দুপুরের ট্রেনটাতেই তখন বেশি চড়তাম আমরা। সকালে ঘুম থেকে উঠে ট্রেন ধরার ঝক্কি কিংবা রাতে ঘুমের সমস্যা করে কোথাও যাওয়ার কষ্ট করতে মন চাইতো না। দাদাভাই ১৫ দিন কিংবা মাসে একবার আসতো। সে আসতো সাধারণত রাতের ট্রেনে। অফিস শেষ করে ট্রেনে চড়ে সকালে পৌছা যেতো। কিন্তু ফেরার সময় দুপুরের ট্রেন ধরতো। যাবার দিন আব্বা সকালে বিদায় নিয়ে চলে যেতেন। মন খারাপ টারাপতো কখনো বুঝতে দিতেন না। সেটা খুজতেও যাইনি কখনও। শুধু বিকেলে ফিরে আসলে আম্মাকে বলতেন, ছেলে তিনটার দিকে আমার অফিস পেরিয়ে গেলো। আম্মা বলতেন, দেখা হইছে। আব্বা মাথা নাড়তেন। ট্রেন লাইনের পাশের সেই অফিসে যাবার কয়েকদিনের মধ্যেই প্রথম এটি শুনলাম। দেখা হবার বিষয়টি মাথায় ঢুকেনি তখন। কয়েকদিন পরেই কিসের জন্য যেনো হরতাল ডাকা হয়েছে। আব্বাকে নিয়ে গিয়েছি অফিসে। বিকেলে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবো,তাই থেকে গেলাম। সকালের দিকে কোন একটা লোকাল ট্রেন আসলো। দুর থেকে শব্দ শোনেই আব্বা পেছনের জানালা খুলে ট্রেন দেখতে বল্লেন। চাকরী করে এমন বয়েসের কোন ছেলেকে বাবা ট্রেন দেখতে বলছে শুনলে লোকে অবাক হবে হয়তো। কিন্তু আমরা এসবে অভ্যস্থ। চা বাগানের পাশ দিয়ে গেলে আব্বা ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে আমাদেরকে চা বাগান দেখাতেন। টিভিতে শিশুপার্ক দেখালে ডাকাডাকি হতো! টিভিতে লন্ডন শহর দেখাচ্ছে। প্রবল আগ্রহ নিয়ে তিনি রাণীর বাড়ির গল্প করতে লাগলেন, আর আমাকে বসিয়েই রাখলেন, লন্ডন যখন দেখাচ্ছে, রাণীর বাড়ি না দেখিয়ে পারে না, সেটা দেখানোরে জন্য।

আমি জানালা খুলে দাড়ালাম। দেখলাম হেলে দুলে ট্রেনটা পেরিয়ে গেলো পোস্ট অফিসের সীমানা। আব্বা পেছন থেকে ডেকে বল্লেন, মানুষ দেখা যায়? আমি হু বলতেই বল্লেন, টিপু যাবার সময় দরজায় দাড়িয়ে হাত নেড়েছে! এরপর যে কয়েকমাস ছিলেন আব্বা সেই অফিসে, প্রতিবার দাদাভাই যাবার সময় ট্রেনের দরোজা বা জানালা দিয়ে হাত নাড়তেন, আব্বা তার অফিসের জানালায় দাড়িয়ে ছেলেকে দেখতেন…

আমি রোজ শাহজালালের মাজারের পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরি, শাহজালালের মাজারের পাশ দিয়ে ছেলের স্কুলে যাই, যতবার শহরে ঢুকি কিংবা ফিরে আসি, ততবারই মাজারের পাশের রাস্তাটা ব্যবহার করি। আব্বার কবরটা দেখা যায়। আমি কয়েক মূহুর্তের জন্য সেখানে দাড়াই…

কবরের কোন জানালা থাকে না। আব্বা আমাকে দেখার জন্য কোন জানালা ধরে দাঁড়ায় না কখনো…

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা