আয়ুষ্কাল


আমিনুল ভাই তখন  আটত্রিশ বছরের যুবক। কিন্তু দেখলে মনে হয়  কমপক্ষে পঞ্চাশ তার বয়েস। লম্বা পানজাবী, মাথায় টুপি, তার সাথে মিল রেখে গালে পাতলা দাড়ি। তাবলিগের চিল্লা দিয়ে বেড়ায়। উত্তরের কোন এক জেলা থেকে লম্বা তাবলিগী সফর দিয়ে সে আমাদের বাড়িতে এলো। তখন দুপুর, মার্চ মাসের হালকা গরমের দুপুর। তার গাল  ভেঙ্গে বেশ ঢুকে গেছে। চোখের নিচে কালি। ঝোলার মতো ব্যাগটা কোন মতে দরজার কাছে রেখেই সে সটান শুয়ে পড়লো মেঝেতে। বাড়িতে হট্টগোল শুরু হলো। আমিনুল ভাই এর গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। সে কোনমতে বাড়ি পর্যন্ত এসেছে, আর কোলাতে পারছে না।

আব্বা বিকেলে বাড়িতে ফিরেই শুরু করলেন গালাগালি। তাবলিগীর গোষ্ঠি উদ্ধার করতে লাগলেন। আমিনুল ভাই চিচি করে মিহি কণ্ঠে শুধু চাচার হেদায়েত কামনা করছিলো। কিন্তু সেটা এমনভাবে, যেনো আব্বার কানে না পৌছে। আব্বা পারেনতো তখনই বাড়ি থেকে তারে বের করে দেন। তাবলীগের মতো বেকার কাজে যে জোয়ান ছেলে সময় কাটায় তার কোন দরকার নাই। আম্মা নানান চেষ্টায় আব্বারে সামলালেন সে যাত্রায়।

আমিনুল ভাই বাড়িতে আসার পর পরই মা বাড়ির পুরনো লোক মনতেরার বাপকে গ্রামের বাড়িতে পাঠালেন। সে সন্ধ্যার ঠিক লাগোয়া সময়ে বড় চাচীরে নিয়ে এলো। আব্বা আবারও রেগে গেলেন। ছেলেকে কেনো বাড়িতে তালা দিয়ে রাখলেন না, এমন পাগলরে ঘরে দড়ি দিয়ে বেধে রাখা দরকার এমন কথার উত্তর দেয়ার সাহস চাচীর ছিলো না। আব্বা শুধু টানা গজ গজ করে গেলেন। আমিনুল ভাই তখন অনেকটা সামলে নিয়েছে। হান্নান ডাক্তার তাকে দেখে গিয়েছে ইতিমধ্যে। পেটে দানাপানির সাথে ঔষুধও পড়েছে। সে আস্তে আস্তে তার দুস্টামি মাখা কথাও শুরু করেছে। আমরা গোল হয়ে তার চারপাশে বসে আছি। সে তাবলিগের গল্প করছে। লোভাতুর নানা বর্ণনা দিচ্ছে রাজশাহী অঞ্চলের। আমের বোল দেখে এসেছে। মে মাসের শেষ দিকে সে আবার যাবে, আল্লার রাস্তায় সফরের সাথে সাথে আম-লিচুও খাওয়া হবে বিস্তর। তার বর্ণনা ভঙি ছিলো অসাধারণ। মিন্টুভাই সেই ভঙিতেই ঠেসে গেলো। বায়না ধরলো তাকেও সাথে নিতে। আমিনুল ভাইতো কোনমতেই রাজী না। বার বার বলছে, নারে ভাই, ছোটচাচা আমারে বাড়ি থেকে বের করে দেবে তাইলে। মিন্টুভাই বল্ল সে নিজে আব্বারে বুঝাবে। তাছাড়া তখন তার স্কুল বন্ধ থাকবে। তখন একটু সায় দিলো আমিনুল ভাই। কিন্তু সাথে অদ্ভুত একটা কথাও বল্ল, কঠিন গলায় বল্ল, 'তোর এইসব মিন্টু ফিন্টু সেখানে চলবে না কিন্তু।' আমরা না বুঝে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এটা আবার কেমন কথা। তখন সে বুঝিয়ে দিলো। মিন্টু নামটাতো ভদ্রস্থ না, আর যেহেতু মিন্টুর একটা ইসলামী না আছে, সেহেতু সেই নাম, মানে মুনতাসির নামেই সেখানে তাকে পরিচয় দিতে হবে। তাছাড়া জামাতের নায়েবে আমীরের ভাই এর নাম মিন্টু হওয়া নাকি শোভন না। আমরা তখন জানলাম আমিনুল ভাই সেই তাবলীগ জামাতের নায়েবে আমীর, যার অর্থ সহ-সভাপতি।

আমিনুল ভাই ৩/৪ দিনের মাথায় সেরে উঠলো। লম্বা যাত্রার ধকল, ঘুম-খাবারের অনিয়মের জন্যই তার শরীর খারাপ হয়েছিলো। ডাক্তার-আব্বা-আম্মা-চাচী সবারই সেই মত। কিন্তু আমিনুল ভাই সেটা মানতে নারাজ। সে বল্ল তার আসলে অন্য সমস্যা। সেটা সময় হলেই বলবে। আব্বা দিন সাতেক পরে তাকে ডেকে নিলেন। তার সমস্যা কি সেটা জিজ্ঞেস করলেন। প্রথমে আমতা আমতা করলেও একসময় সে বল্ল, তার নাকি পানি খেতে ভালো লাগে না, তিতা তিতা লাগে। আব্বা একটুক্ষণ থম মেরে গেলেন, তারপর বল্লেন, জ্বরের জন্যই এমনটা হয়েছে। আমিনুল ভাই মাথা নাড়তে নাড়তে বল্ল, না। মাস খানেক ধরেই তার এমন হচ্ছে। আব্বা এবার বেশ অসহিষ্ণু হয়ে পড়লেন। ধমক দিয়ে বল্লেন কি যা ইচ্ছা তাই বলিস। তিরিশ বছর হয় নাই বয়স তর আবার পানি তিতা লাগবো ক্যান? আমিনুল ভাই শুধরে দিয়ে বল্ল তার বয়েস আটত্রিশ। আব্বা ধমক দিয়ে তারে সরিয়ে দিলেন। বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারলাম না আমরা। পানি তিতা লাগাতো রাগ করার মতো বা ভয় পাবার মতো কোন বিষয় না। জ্বর হলেতো সবারই এমন লাগে। আমিনুল ভাই সে কথা আমাদের বুঝাতেও চায় না। তবু আমরা নাছোড় হয়ে তারে ধরি।

দাদাজানের তখন পয়তাল্লিশ বছর বয়েস। আব্বা মাত্র দশ বছরের। গ্রামের ভারতের ইশকুলে পড়েন। সেই বয়েসে দাদাজান বলতে লাগলেন তার মরণের সময় উপস্থিত, কারণ তিনি পানির স্বাদ পাচ্ছেন না। তিতা তিতা লাগে। এই অসুখেই দাদাজানের বাপ দাদা মারা গেছেন! তারপর সত্যি সত্যি দাদাজান সেই বছরটা না ঘুরতেই মারা গেলেন! গল্পটা ভয় ধরানোর। আমরা ভয় পেলাম, কিন্তু সেটা অল্প সময়ের জন্য। মিন্টুভাই আমাদের ভয় কাটিয়ে দিয়ে বল্ল, আমিনুল ভাই হিসাব মতো আরো সাত বছর বাঁচবে। পয়তাল্লিশ হতে নাকি আরো সাত বছর বাকি। তবুও সুরটা যেনো কোথায় কেটে গেলো। চাচী কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেল্লেন, আর পরের সকালে জোর করে আমিনুল ভাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন তিনি। আব্বা কিংবা আম্মা তেমন উচ্চবাচ্চ করলেন না। আমিনুল ভাই যাবার আগে  মিন্টুভাইকে বলে গেলো জুন মাসের জন্য রেডি হতে। কিন্তু সেই জুনে আমিনুল ভাই আর রাজশাহী যেতে পারলো না। কাঠফাটা গরমের এক দুপুরে সে কোন কিছু জানান না দিয়ে মরে গেলো। আমাদের ভাইদের মাঝে ধাম করে একটা ড্যাশ চিহ্ন একে দিয়ে আমিনুল ভাই সত্যি সত্যি মরে গেলো।


মানুষের গড় আয়ু নিয়ে আব্বা খুব কথা বলতেন। বাংলাদেশের মানুষ গড়ে পঞ্চান্ন বছর বাঁচে এমন একটা তথ্য দিয়ে তিনি বলতেন তার নাকি এক্সট্রা লাইফ চলছে।  কিন্তু সেটা বেশি টেনে নিতে পারলেন না। তেষট্টি বছর বয়েসে বুকের হাল্কা ব্যাথায় আব্বা চলে গেলেন। কিন্তু তার বছর খানেক আগে থেকেই আব্বা প্রস্তুত হচ্ছিলেন চলে যাবার জন্যে। প্রথম দিকে সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। যখন বুঝলাম, তখন উড়িয়ে দিতে চাইলাম বিষয়টা। কিন্তু তবু মনের ভেতর খট-খট, খট-খট করতেই থাকলো। পারভিন তখন মাত্র বি,এ পাশ করে একটা স্কুলে ঢুকেছে। সে তার বেতন পেয়ে কয়েক ডজন পানির বোতল নিয়ে এলো। আব্বা প্রবল আগ্রহে সেটা খাওয়ার চেষ্টা করলেন, হলো না। ডাব খেলেন কিছুদিন, তারপর সেটাও তিতা লাগতে শুরু করলো। এসব করতে করতে মাস ছয়েক হয়তো গেলো, আব্বা হাল ছেড়ে দিলেন। তারপর সেই চুড়ান্ত দিন। আমরা শুধু অসহায়ের মতো আব্বার চলে যাওয়া দেখলাম।


আম্মার চোখে সমস্যা দেখা দিয়েছে। অস্বাভাবিক কিছু না। এ বয়েসে সবারই কম বেশি চোখের সমস্যা হয়। কিন্তু আম্মা তার সমস্যাটা বাড়িয়ে দিয়েছেন নিজে। তিনি চশমা পরতে পারেন না। চশমা পরলে নাকি সবকিছু দোতলা হয়ে যায়। প্রথম প্রথম চশমা পরলে এটা হয় সবার। সময়মতো সেটা কেটেও যায়। কিন্তু সেই সময়টাই দিচ্ছেন না। তার জীবনটা স্থবির হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ঘরের পরিচিত বলয় ছাড়া তিনি বেরুচ্ছেন না। আন্দাজে যা যা করা যায় সেটাই করে যাচ্ছেন। তবু খাবার টেবিলে তার রোজ বসতেই হবে। আমার খাবার দাবার ঠিকমতো হচ্ছে কী না এই  দায়িত্ব আর কারো উপর ছেড়ে দিতে তিনি নারাজ। আমার বউ এ নিয়ে ঠাট্টা করে, আগে সেটা অভিমান ছিলো। মেনে নিয়েছে এখন। কিন্তু ঠাট্টাটা আর ছাড়েনি। আম্মা কঠিনভাবে আমাকে খাওয়াবেন বসে বসে। কি খাচ্ছি, কতটুকু খাচ্ছি সেটা দেখার সময় তার চোখে কোন সমস্যা থাকে না। তাই ফাকিঁবাজি করা যায় না। কয়েকদিন ধরেই তার হিসাব মতো আমি পানি কম খাচ্ছি। প্রতিবার খাবারের সময় সেটা বলছেন। আমার সমস্যা কি সেটা জিজ্ঞেস করছেন। আমি প্রবলভাবে তাকে বুঝাতে চেষ্টা করছি, আমার কোন সমস্যা নেই। যতটা পানি খাবার দরকার, ততটা আমি খাচ্ছি। তবু তার সন্দেহ দুর হয় না। আজ খুব ধীর গলায় তিনি বল্লেন- টিটন, সত্য করে বলতো বাবা, তোর কি পানি খেতে সমস্যা হয়, তিতা তিতা লাগে? আমি জোর গলায় হেসে উঠি। মাকে বলি, তুমি কি ভাবছো মা? আমি মরে যাবো এটা ভাবছো নাকি? নিশ্চিত থাকো সেইটা হবে না। আমি তোমারে কবরস্থ করবো, এইটা একটা পাক্কা কথা। মা কিছু বলেন না। তিনি আবারও আগের মতোই জিজ্ঞেস করেন, সত্য করে বল টিটন, আমারে ফাঁকি দিস না। আমি বলি, না মা, সত্যি বলছি, আমার তিতা লাগে না। মা নিশ্চিত হোন। আমি উঠে পড়ি। মায়ের সাথে মিথ্যা বলে আমি অফিসের পথে হাটি...

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা