তিনি বৃদ্ধ ছিলেন

চোখে ছানি পড়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। সে বছর দশেক হবে কম করে হলেও। চোখেরইবা কি দোষ। বয়েসতো কম হলো না। বড় মেয়ের ঘরের নাতির বিয়ে হয়েছে ৭ বছর আগে। আর বড় ছেলে তার মেয়ের বিয়ে দিয়ে ৩ নাতির নানা বনে গেছে। চোখের ছানি নিয়ে তাই কোন অভিযোগ নেই তার।
এখানে, এই সবুজ গ্রামের পাশে যে নদী বয়ে গেছে, সেই নদীর পাড়, শান্ত মাঠ, সবই তার চেনা। তিনি ছানিপড়া চোখে সেই নদীর পাশ দিয়ে অবলীলায় হাঁটতে পারেন। নদীর সাথে লাগোয়া মাঠ, সেই মাঠের এক পাশে দাড়িয়ে থাকা মেন্ডা গাছ, সব তার মুখস্থ। তিনি তার অভ্যস্থ পায়ে তরতর করে হেঁটে মেন্ডা গাছটার নিচে এসে দাঁড়াতে পারেন। রোজ বিকালে সেখানে তাকে দাঁড়াতে হয়। অভ্যাস। তার শরীর নদীর বাতাসে জুড়িয়ে যায়। তার মখমলের মতো সাদা দাড়ি বাতাসে উড়ে। ছানি পড়া চোখে তিনি অনুভব করেন ঠিক সামনে, চোখেন সীমানায় দাড়িয়ে আছে খাসিয়া পাহাড়, পাহাড়ের শরীর চিড়ে নেমে আসছে পাংথুমাইর ঝরণা। এই ঝরণায় জোয়ান বয়েসে হরদম গিয়েছেন তিনি। এখন আর যাওয়ার উপায় নেই। এলার্ট বলে এপার-ওপার দুপার থেকেই চিৎকার আসে, থেমে যেতে হয়। তিনি অনুভব করেন, দেখতে পান তার ডান পাশে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে জাফলং পাহাড়, কত অবাধ যাতায়াত ছিলো এই সবুজে, এখন সব অন্যের, কোন অধিকার নেই আর...
আজও হাঁটতে তার কষ্ট হয় না। তিনি সামনে একা হাঁটেন। তার হাতের লাঠিটা মাটিতে লাগে কি লাগে না, তিনি তরতর করে হাঁটেন। পেছন পেছন যারা আসে তাদের কথা তিনি বুঝেন না। বুঝবার দরকারও নেই। শুধু আজির উদ্দিন চেয়ারম্যান এর অনুরোধ তার কানে আসে। পাশাপাশি হাঁটছে সে, আর বলছে, ‘চাচা খইদেউকা, ই বয়েসো আপনার উপরে জুলুম ওউক ইতা আমার বালা লাগের না। আপনার হুরু পুয়া কই গেছে কইদেউকা, আপনার দায়িত্ব আমার। কেউ আপনারে কিচ্ছু খরতোনায়...’ এসব কথা শোনার কেনো মানে নেই। তিনি শোনেনওনা। তিনি তার প্রিয় মাঠ পেরিয়ে, মেন্ডা গাছটার নিচে দাঁড়ান, দাড়িয়েই থাকেন... তার ঝাপসা চোখের সামনে পিয়াইনের স্বচ্ছ জল বয়ে চলে, তার চোখের সামনে ঝর-ঝর করে ঝরতে থাকে খাসিয়া পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা ঝরনার জল। পচানব্বই বছরের নরোম শরীর পিয়াইনের পানিতে ঝরে পড়ার আগে তার বুকে টকটকে লাল একটা পতাকা জেগে উঠে...

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা