এইসব মৃতকথামালা

জগন্নাথপুরে আমাদের স্কুলের ঠিক পাশেই ছিলো একটা দিঘি। সেই দিঘির পারে সারবাধা আম গাছ। স্কুলের আশেপাশের বাড়িতেও বিস্তর আম গাছ। আমের বোল থেকে ছোট ছোট আম বের হতে শুরু করলেই আমাদের অভিযান শুরু হতো। সেকালে মানুষ অনেক সহনশীল ছিলো, তাই গাছের উপর ইচ্ছামতো নির্যাতন চালাতাম আমরা। এখানে আমরা বলাটা হয়তো ঠিক হচ্ছে না। বেটে গাব্দা গোব্দা আমার পক্ষে গাছে চড়া কিংবা ঢিল ছোড়ে আম পাড়া হয়ে উঠতো না কখনই। তবু আমার কাছে আমের অভাব হয়নি কখনো। কবির নামের মহা দস্যি ছেলেটা না চাইতেই ইচ্ছামতো আম নেবার পারমিট দিয়ে রেখেছিলো আমাকে।
কবিরের সাথে প্রায়ই আমি স্কুলে যেতাম। বাড়ির পাশের রাস্তায় দাড়িয়ে কবির আমার নাম ধরে ডাকতো। এর আগে প্রায় ২০ মিনিট হেটে আসতে হতো তাকে। সে একা আসতো না। একটা বিরাট দল ছিলো তার। আমি সেই দলের সাথে যোগ দিতাম। স্কুলে একসাথে গেলেও ফেরা হতো না একসাথে। কবির স্কুল ছুটির অনেক আগেই ফুড়ুৎ করে স্কুল পালাতো। এই বিষয়ে সে একটা প্রতিভা বিশেষ। আমার জীবনে এমন এক্সপার্ট ক্লাস ফাঁকি দেনেওয়ালা আর ২ টা পাইনি। ফেরার পথে বেশিরভাগ দিনই থাকতো মহাদেব। টিংটিঙা লম্বা মহাদেব। তার বেয়াড়া পা হাফ প্যান্টের বাইরে বেমানানভাবে লটকে থাকতো যেনো। ডাকাবুকো কবিরের একেবারে বিপরিত ছিলো মহাদেব। শান্ত, নির্জন।
ঝিনুকের পেট ঘষে ঘষে ধারালো ছুরির মতো একটা কিছু বানাতো স্কুলের ছেলেরা। সেটা প্রায় সবার পকেটেই থাকতো। কায়দা করে আম ছিলে খেতো ওটা দিয়ে। আমি ঝিনুক দিয়ে আম ছিলতে পারতাম না। মহাদেব একদিন ছোট্ট একটা দা নিয়ে এলো। দুই বা আড়াই ইঞ্চি ছিলো সম্ভবত সেটা। কাঠের বাট লাগানো। দেখেই মুগ্ধতা জেগেছিলো। আমি প্রচন্ড অবাক হলাম, যখন মহাদেব সেটা আমাকে দিয়ে দিলো! ঝিনুক দিয়ে আম ছিলতে পারি না দেখে মহাদেব নিজে এটা বানিয়ে এনেছে। জগন্নাথপুর বাজারে মহাদেবদের একটা কামারের দোকান ছিলো। স্কুল থেকে ফিরে সেখানে কাজ করতো মহাদেব। অদ্ভুদ একটা হাতেটানা যন্ত্র ছিলো সেখানে। লটকে থাকা দড়ি ধরে মহাদেব টানতো। শো শো বাতাস বেরুতো একটা পাইপ দিয়ে, তাতে টকটকে লাল আগুন জ্বলতো কালো কয়লায়। সেই কয়লায় লোহার পাত দিয়ে আরো বেশি লাল করে ফেলতো মহাদেব। তারপর সেই লাল লোহা পিটিয়ে নানা যন্ত্র বানাতেন মহাদেবের বাবা। কত বিকেল আমি সেই দোকানে, মাহাদেবের পাশে বসে এইসব কারিকুরি দেখতাম... মহাদেব দু একবার তার হাতের দড়ি আমার কাছে দিয়েছে, আমি শরীরে সব শক্তি দিয়ে টেনেছি সেই দড়ি, এক ফোটা ফুলকিও তুলতে পারিনি কোনোদিন, কোনদিন না।
আব্বা বদলি হয়ে গেলে বাক্সোভর্তি স্মৃতি নিয়ে আর পৃথিবীজোড়া স্মৃতি হারিয়ে আমি জগন্নাথপুর ছেড়েছি। দুই যুগের বেশিকাল পর, আমার সেই বাক্সোটাও অনেক ফাঁকা এখন। স্মৃতি নাই, চুরি হয়ে গেছে সেই ভেজা ভেজা স্মৃতিগুলো। মরে গেছে তারা। শুধু দীর্ঘ বালুতটে সকালের রোদে কিংবা প্রবল জোৎস্নায় চিকচিক করে ওঠা অচেনা কনার মতো জ্বলজ্বলে হয়ে আছে মহাদেব, কবির, সোহেলের মতো মানুষের মুখ, বন্ধুর মুখ...
আমার কাছে বন্ধু বলতে মুড়ি-মুড়কির মতো ছিটকে পড়া কিছু প্রিয়মুখ ছাড়া আর কিছু নয়। আমার কাছে বন্ধু মানে হারিয়ে যেতে যেতে, মরে যেতে যেতে বেঁচে যাওয়া কয়েক টুকরো স্মৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। আমি বিপর্যয়ের কালে দেখি, অসুস্থ ভাইকে নিয়ে দিন-রাত উজাড় করে দেয়ার সময়ে হঠাৎ কেউ একজন হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে সস্থা চায়ের দোকান থেকে আমাদের মতো সস্তা মানুষের জন্য বানানো এক টুকরো কেক মুখে গুজে দিয়ে বলছে, কি অবস্থা হয়েছেরে তোর, এরকম মর্কটের মতো হয়ে গেছিস কেনো? এভাবে চল্লেতো হাওয়ায় মিশে যাবি... এই স্মৃতিই আমার কাছে বন্ধুতা। আমাদের মাঝে সবচে নরোম মানুষটা পোষাকী জীবন বেছে নিলে, মে মাসের শেষ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শহর ঘুরে বেড়াবার নাম বন্ধুতা। আমাদের চিঠিযুগে, একটা দুলাইনের চিঠির নির্দেশে রেলস্টেশনে বসে থাকার নাম বন্ধুতা। বন্ধুতা মানে ট্রেনে তুলে দিতে এসে শেষ মুহূর্তে লাফিয়ে উঠে পড়া! তারপর সারারাত কু... ঝিকঝিক, কু... ঝিকঝিক নিয়ে শীতে জমতে থাকা।
বন্ধুতা মানে একরাশ মৃতকথামালা, যারা খুব একা সময়ে প্রাণ ফিরে পায়, গলায় দলা পাকায়, উচাটন করে মন, আর চোখে জমে কুয়াশা...

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা