এবং বন্ধুতা...

ঝুমুর বয়েসে বড় ছিলো আমাদের, তাই নামের শেষে দাদা যোগ করে সে আমাদের বন্ধু হয়ে গেলো। ঝুমুরদা। মূলত এটা একটা নামই শেষ পর্যন্ত। ওসব দাদাগীরি কি আর চলতো! দীর্ঘ বছর আমরা আড্ডা দিয়েছি। উদ্দাম তারুণ্য বলতে যে সময়টা থাকে, ঠিক সেই সময়ের বন্ধুদের একজন ঝুমুর।
এই বয়েসে একটা দলের সাথেতো আর সময় কাটানো যায়না। নানা ধরণের বন্ধু বান্ধব জুটে যায়। তারপর বয়েস বাড়ার সাথে সাথে যেকোন একজন, দুজন অথবা বিশেষ একটা গ্রুপের সাথে যোগাযোগ হয়তো বেশি থাকে, অন্যদের সাথে সেটা কমে। কোন কোন ক্ষেত্রে বন্ধই হয়ে যায়। স্টেডিয়াম পাড়ার সৈকত রেস্তোরাতে বসে আমরা যারা আড্ডাবাজি করতাম, সেটা খেলাধুলাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিলো। সেই গ্রুপে কেউ ক্রিকেট খেলতো, কেউ হকি, কেউ ফুটবল। কোন ধরণের খেলাধুলা না করেও আমি আর শামীম সেই গ্রুপে কেমন করে ঢুকে গিয়েছিলাম সেটা আর মনে নাই। কিন্তু টানা ৪/৫ বছর সেই আড্ডাটায় ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়েছি আমরা। আর সেই আড্ডার মধ্যমনি ছিলো এই ঝুমুরদা। বিচিত্র কাণ্ডকারখানা, মজার মজার কথা দিয়ে আড্ডা মাতিয়ে রাখতো। সৈকত রেস্টুরেন্টের টেবিল কিংবা স্টেডিয়ামের যে কোন একটা গ্যালারী দখল করে প্রতিদিনের আড্ডার আজান দিতো এই ঝুমুর।
শামীমের বাবা মারা গেলেন হঠাৎ। বাড়ির বড় ছেলে হিসাবে সংসারের হাল ধরলো সে। বাবার ব্যবসায় যোগ দিলো। আমি আস্তে আস্তে নাটকের কাজে জড়িয়ে গেলাম। সৈকতের সেই আড্ডায়ও যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো একসময়। অন্যরাও এদিক সেদিক চলে যেতে লাগলো, রেস্টুরেন্টের টেবিলতো ফাঁকা থাকেনা। সেখানে নতুন আড্ডারুরা এসে যোগ দেয়। আমার সেসব খবর নেয়া হয় না। স্টেডিয়াম পাড়ায় যদিও যাওয়া হয়। একদিন সেখানেই পাকড়াও করলো ঝুমুরদা। ব্যপক হাউকাউ, টানতে টানতে নিয়ে গেলো সৈকতে। একটা টেবিল ঘিরে বসে আছে জুনিয়র কয়েকটা ছেলে, মুখ চিনি কারো, কাউকেবা নামে চিনি, ঝুমুর টুপ করে সেখানে বসে গেলো, তখনও সমানে খিস্তি করছে। তার খিস্তি, সামনে আমি এসব নিয়ে বসে থাকারা যেমন বিব্রত, আমিও ততটাই। মিনিট দশেক সেখানে বসে ফিরে এলাম। আমাকে আবার এগিয়ে দিতে এলো ঝুমুরদা, মন খারাপ করে বল্ল, তোমরা কেউ আসোনা, এই বাচ্চা বাচ্চা পোলাপানের সাথে আমি এখন আড্ডা দেই! কিছু বলার ছিলো না আমার, কাজের দোহাই দিলাম শুধু।
ম্যালাদিন পরে, সম্ভবত বছর দশেক হবে, আমাদের পাশের পাড়াতেই ওর সাথে আবার দেখা। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ইয়া আলী বলে কোলাকুলি... মুখে কাচাপাকা দাড়ি! কি অবস্থা, কেমন আছো এসব আটপৌরে কথাবার্তা হয়। হাতের ব্যাগ থেকে এক প্যাকেট মোম বের করে দিলো ঝুমুরদা! ‘লোকনাথ মোমবাতি’। এই মোম ফ্যাক্টরির মালিক সে। আমাদের পাশের পাড়াতে বাড়ি করেছে তারা। সেই বাড়িতেই এই মোম ফ্যাক্টরি। দেখে খুব ভালো লাগে। প্রশংসা করি। ভালো চলছে তার, সে কথা শুনে আনন্দিত হই। কিন্তু ঝুমুরদা বেশ মন খারাপ করে বলে, কারো সাথে যোগাযোগ হয় না আর। সময় পায় না! আমি বলি জীবনের নিয়মই এই। কিন্তু ঝুমুর সেটা মানতে নারাজ। তার কথা হলো, রোজ যদি বন্ধুদের সাথে আড্ডাই না দিলো, তাহলে আর কিসের জীবন! সেই শেষ দেখা। আর কখনো দেখা হয়নি ওর সাথে।
ফেসবুকে একটা ছবি পেলাম আজ, এক অচেনা সন্ন্যাসীর। এরকম ছবি দেখলে কোন আগ্রহবোধ করিনা। পরিচিত কেউ পোস্টও করেনি, ফেসবুক কোন এক বন্ধুর বন্ধুকে আমি বন্ধু বানাতে আগ্রহী কীনা সেটা জানার জন্য এই ছবি লটকে দিয়েছে। চোখের কোনায় আটকে গেলো ঝুমুর শব্দটা। পড়ে দেখি এই আমাদের ঝুমুর!!! যিনি ছবিটা দিয়েছেন, তিনিও আমারই মতো ঝুমুরের আরেক ছোটভাই বন্ধু, তার সাথেও ঝুমুরের অনেকদিন দেখা নেই। হঠাৎ করেই পেয়ে গেলেন এই সন্ন্যাসীকে, আর অবাক হয়ে আবিস্কার করলেন এ আর কেউ নয়, প্রিয় ঝুমুরদা!
ফেসবুকে অচেনা জঞ্জাল এড়িয়ে চলতে চলতে এইযে মনের খুব ভেতর থেকে কিছু একটা উকি দিয়ে ঝুমুরের নামটা দেখে ফেল্ল। এইযে ঝুমুর এসে টেনে হিচড়ে ষোল, সতেরো, আঠারো, উনিশ কিংবা বিশ বছরের আমাকে আবার নিজের সামনে দাড় করিয়ে দিলো, সম্ভবত এরই নাম বন্ধুতা!

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা