হিঙ্কলি রোড কর্নার

মোড়ের পাশের ফুলের দোকানটা বন্ধ হয়ে গেল।
ফুলের দোকান, তারপর একটা চিকেন এন্ড চিপসের দোকান, এরপর নাপিতের দোকান তারপর টনি পাপটের অফ লাইসেন্স। এর ঠিক লাগোয়া বাসস্টপ। বাসস্টপে সারাদিন হুইল চেয়ার নিয়ে বসে থাকে ডেভিড। সামনে দিয়ে যে-ই যাক, নিচু গলায় ভাংতি পয়সা চায়। কেউ দেয়, কেউ দেয় না। সে বসেই থাকে। পাশ দিয়ে কোনো বাচ্চা যদি বাবার সাথে যায় তখন শুধু একটু উঁচু গলায় বলে, বাবাকে আঁকড়ে ধরো, জাপটে ধরো, দুনিয়ায় এই একটাই বাবা তোমার! রোজ যারা হাঁটে এই পথে তারা ছাড়া, নতুন বাচ্চারা একটু ভয় পায় আর বাবার হাতটা শক্ত করে ধরে। যারা জেনে গেছে ডেভিডকে, তারা আগে থেকেই ধরে থাকে হাত আর একটু সাহসী যারা তারা হাতটা একটু উঁচু করে ডেভিডকে দেখিয়ে দেয়। ডেভিড কখনো বাচ্চাদের কাছে পয়সা চায় না। বাচ্চা থাকে যেসব বাবা মায়ের সাথে তাদের কাছে পয়সা চায় না।
রাত আটটায় টনি তার দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার সময় সস্তা বিয়ারের একটা ক্যান ধরিয়ে দেয় ডেভিডের হাতে। তারপর নির্জন হতে থাকা বাসস্টপে ডেভিড বসে থাকে। টনি অফলাইসেন্সের নিয়ন সাইনটা একবার জ্বলে আর একবার নিভে, বাড়ি ফিরে যাবার আগ পর্যন্ত ডেভিডের মুখে খেলা করে সেই আলো।
ফুলের দোকানের উপরে একটা দুই কামরার ফ্ল্যাট। ইউসুফ তার আট বছরের ছেলে ইজ্জত আর বউ এলিয়নাকে নিয়ে থাকে এখানে। ইউসুফ পাকিস্তানি, এলিয়না বসনিয়ান মুসলমান। ইজ্জতের সাথে ডেভিডের খুব খাতির। রোজ দুপুরে, স্কুল থেকে ফেরার পথে একবারের জন্য হলেও ডেভিডের সাথে তার গল্প করা চাই-ই চাই। ইউসুফ কখনোই চিকেন এন্ড চিপসের দোকানটায় ঢোকে না। সে কমপক্ষে আধা মাইল দূরের একটা দোকান থেকে ছেলের জন্য প্রতি শুক্রবার চিকেন এন্ড চিপস নিয়ে আসে। সেই দোকানের সাইনবোর্ডে হালাল লেখা থাকে। তারপর টনির দোকান থেকে ভদকার বোতল নিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ে।
রোজ বিকেলে মায়া প্যাটেল তার টিঙটিঙা শরীরকে আরও টিঙটিঙা করার আশায় কানে ইয়ারফোন গুঁজে রিন্ডলি স্ট্রিট থেকে দৌড়ে আসে মোড় পর্যন্ত। আবার ভেতরে যায়, ফিরে আসে, আবার যায়... বিশ নাম্বার চক্করের সময় ডেভিড গলা খাঁকারি দেয়, মায়া ফুলের দোকানের সামনে থেকে আস্তে আস্তে হেঁটে আসে, বাসস্টপের খাড়া বেঞ্চে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে কথা বলতে থাকে ডেভিডের সাথে। কোনো আগামাথা নেই সেসবের, এই হয়ত কেনিয়াতে মায়ার ফেলে আসা বাড়ির কথা হচ্ছে আবার একটু পরেই সেটা টেসকোর ডিম নয়ত হালাল বুচারের বাখারকে নিয়েও হতে পারে।
ব্রোনস্টোন রোডের ক্যারিবিয়ান উইন্ড প্রতি শুক্রবারে প্রাণ পায় যেন। মাঝরাত অব্দি চলে হুল্লোড়। বাসস্টপের ঠিক উলটোদিকে একটা ক্যাশ মেশিন। রাত যত বাড়তে থাকে সেই মেশিনের সামনে লাইন তত বড় হয়। লাইন বড় হয়, খিস্তিখেউড় বাড়তে থাকে। মারামারি, হাতাহাতি, প্রেম সবকিছুকে অভিনীত হয় ক্যাশ মেশিনকে ঘিরে। ডেভিড তখন থাকে না এখানে। শুক্রবার বিকেল থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত ডেভিডকে দেখা যাবে না। এই সময়টাতে সে যে কী করে তাও কেউ জানে না। সোমবার সকালে মাসগ্রোভ ক্লোজ থেকে আস্তে আস্তে হুইল চেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে ডেভিডকে আসতে দেখা যায়। ফুলের দোকানের পাশে লোহার একটা সিঁড়ি, ইউসুফের ঘরে ওঠার, সেই সিঁড়িতে মাঝে মাঝে বসে থাকে এলিয়না। ডেভিড একটু থমকে দাঁড়ায় সেখানে। এলিয়নাকে জিজ্ঞেস করে কেমন আছে, ইচ্ছে হলে সে উত্তর দেয়, ইচ্ছে না হলে নাই। এলিয়নার দেওয়া চুরুট টানতে টানতে টনি অফলাইসেন্সে ঢুকে যায় ডেভিড। ল্যাস্টার কিংস এর জার্সি পরা কেইভেন হয়ত তখন বাস থেকে নামে, তার চিকেন এন্ড চিপসের দোকান খুলবে বলে।
সিঁড়িতে বসে চুরুট টানতে টানতে এলিয়না বলে, ফ্লাটটা ছাড়ছে তারা। শ্যাফ্টবারি রোডে, ইজ্জতের স্কুলের পাশের একটা বাড়িতে উঠবে দুই সপ্তাহ পর। অন্যদিনের মতো আর চুরুটের জন্য হাত বাড়ায় না ডেভিড। আস্তে আস্তে হুইল চেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে বাসস্টপের দিকে এগিয়ে যায়।
সোমবার সকালে বাসস্টপে একটা নোটিশ সেঁটে দেয়া হয়, সেখানে লেখা থাকে ‘ফ্লোরিশ ফিউশন’ নামের দোকানটায় একটা টার্কিশ কাবাবের দোকান করার প্রস্তাব করেছেন দোকান মালিক। সেখানে বড় চুলা বসানো হবে। মাংসপোড়া গন্ধ আসতে পারে বাতাসের ঝাপটায়। খাবারের দোকান তৈরিতে এবং বড় চুলা বসানো নিয়ে কারো কোনো আপত্তি থাকলে ৭ দিনের মধ্যে কাউন্সিল অফিসে জানাতে হবে।

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

বিকেলের রোদে দেখা মেয়ে