হাসপাতালের দিনগুলো...

রাত এগারোটায় হাসপাতাল থেকে ফোন আসলো, আপনি মি. তুলি? হ্যাঁ বলতেই বল্লো, মাত্র ফোন পেলাম। আপনার স্ত্রীকে পোস্ট অপারেটিভ থেকে নিয়ে আসবে ১৫ মিনিটের মাঝে। আসতে চাইলে আসুন। বল্লাম, আধা ঘন্টা লাগবে কমপক্ষে। উত্তরে হ্যাঁ সূচক জবাব পেলাম। আবার আব্দার করলাম, ছেলেকে নিয়ে আসবো... তাতেও হ্যাঁ।
গত ৩/৪ ঘন্টা ধরে এই মহিলাকে ১৫/১৬ বার ফোন করেছি। গলা শুনে অনেক বয়েসী কোন মানুষ মনে হয়। ছেলেকে নিয়ে ছুটলাম। রাস্তা একদম ফাঁকা, তবু জোরে চালানো যাবেনা। মোড়ে মোড়ে ক্যামেরা। লাইসেন্সে এমনিতেই তিন পয়েন্ট জমা হয়ে আছে। আর কিছু হলে ব্যান করে দেবে।
বাবাই লম্বায় সেই কবেই আমাকে ছাড়িয়েছে। এখন মনেহয় বুঝতে পারাতেও... বারবার বলে, বাবা চিন্তা করোনা। মা ঠিক আছে। তুমি ঠিক থাকো। ভেতরে ভেতরে আরো গলে যাই, ছেলেটা ভেতরে বিষ চাপা দিতে শিখে যাচ্ছে।
যা ভেবেছিলাম তাই। আম্মার বয়েসি নার্স। ওয়ার্ডের দরোজায় দাঁড়িয়ে। "দেখো বাবা, এটা একদম নিয়মের বাইরে। তোমার বার বার ফোনের কারণে আমি সুযোগটা দিচ্ছি। আস্তে আস্তে যাবে। কথা বলবেনা। লম্বা অপারেশন হয়েছে। এটা সবচে বড় অপারেশন গুলোর একটি। মেয়েটা এখন ঘুমুচ্ছে। শুধু চোখের দেখা দেখবে।" হাঁটছেন আর কথা বলছেন। ছেলের হাত ধরে পাশে পাশে চলছি।
সাড়ে দশ ঘন্টা পর পর আমাদের দেখা হলো। এবার তিনি ফিস ফিস করে কথা বলছেন। রুগীর সাথে যে ফাইল এসেছে এবং যিনি ওকে দিয়ে গেছেন তার কথা অনুযায়ী তোমার স্ত্রী ভালো আছেন। এর বেশি কিছু আমি বলতে পারবোনা। প্রার্থনা করো। ঠিক দশ মিনিট পর তোমাদের চলে যেতে হবে, বলে তিনি পর্দা টানিয়ে চলে গেলেন।
চোখ অল্প একটু মেলে তুলি বলে, চলে যাও। ঠিক আছি। বল্লাম, দশ মিনিট মাত্র সময়। তুমার ছেলে এসেছে, দেখেছো? মাথা নাড়ার চেষ্টা করলো মনে হলো। দু-তিন মিনিট আর কোন কথা নেই। আবার একটু চোখ মেলে বলে, মাথা এদিকে আনো, কথা বলি। এগিয়ে গেলাম, কিন্তু কথা নেই। আরও মিনিট দুয়েক পর, একদম ফিস ফিস করে বল্লো, আমি কিন্তু ঘুমাই নাই, এমনি পড়ে আছি... ভংগি ধরে আছি... নয়তো এরা মরফিন দিয়ে দেবে... আমরা বাপ-ছেলে অবাক হয়ে তাকাই। বাবাই অবিকল মাকে নকল করে বলে, "ভালো করেছো, এভাবে পড়ে থাকো। আমরা চলে যাবো এখন। মিজান আংকেল ঈদের খাবার দিয়ে গেছেন, সেটা গিয়ে খেতে হবে। ঈদের মাত্র মিনিট বিশেক আছে আর!"
আবারও সেই বয়েসি নার্স আমাদের এগিয়ে দেন। বার বার বলেন, চিন্তা করোনা। প্রার্থনা করো। অনেক বড়ো অপারেশন... অনেক বড়ো...
শুনশান নীরব হাসপাতালের করিডোর পেরিয়ে হাঁটতে থাকি। সড়ক বাতির জন্ডিস আলোয় আমাদের ছায়া পড়ে। বাবাইর ছায়ার পাশে আমার ছায়াটাকে মনে হয় বাচ্চা... আজ থেকে উনত্রিশ বছর আগে আব্বা ঠিক এভাবেই আমাকে নিয়ে রাতের সিলেটে বাড়ি ফিরেছেন। আম্মা একা শুয়ে ছিলেন হাসপাতালে। আমি আব্বার হাতে শক্ত করে ধরেছিলাম। সারারাত আব্বার বুকের ভেতর ঘুমিয়ে ছিলাম।
আমার ছেলে বাতি নিভিয়ে বলে, বাবা একদম চিন্তা করোনা। ঘুমানোর চেষ্টা করো। কিছু লাগলে ডাক দিও! বলে নিজের রুমে চলে যায়। বাবাইটা বড়ো হয়ে গেলো...

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা