ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০১

মোবারক তখনও কারিম হয়ে উঠেনি। আলগা আভিজাত্যের রামাদ্বানের সাথেও পরিচয় হয়নি তখন। তখন রোজা আসতো। আসতো প্রবলভাবে। নানাবাড়ির টিলা থেকে আমরা দৌড়ে নেমে যেতাম বাঘা হাওরে, পেন্সিলের টানের মতো একটা চাঁদ দেখলাম কী দেখলামনা, উল্লাসের তাতে উনিশবিশ হতোনা। এই একই ভূমিকায় অভিনয় করেছি কখনো নলুয়ার হাওরের পারে, কখনও রামসুন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে অথবা কালনী নদীর পারে। আমার শৈশব ছিলো উল্লাসে ভরপুর।

শহর সিলেটে তখনও অনেক দোকানের সামনে ছিলো কাঠের দরোজা! একটা একটা করে কাঠের তক্তা খুলে রাখলে আম্মার তেরছা করে লেখা লিস্টি ধরে ডাল তেল ছোলা আর কালিজিরা চালের খুশবো নিয়ে রোজা আসার জানান দিতো তখন। আর নানাবাড়িতে ছিলো বাইংগন বিচি চাউল। উপজেলা সদরের দিনগুলোতে বাজারের খবর আসলে রাখা হতোনা। তাজপুরে বাড়িতে মাইক লাগাতেন ঢাকা টেইলার্সের মালিক। মাঝরাতে শুরু হতো 'সেহরি সুবুর, ওঠো ওঠো, ফতার সময় ওই গেছে' বলে হুলস্থূল। সুহুর পার্টি করা এই সময় বুঝবেনা লতা দিয়ে ফতা খাবার সেইসব সময়ের মায়া।
আম্মার পাশে বসে একটার পর একটা পিয়াজু খেতাম। মনোয়ারা মনজিলের খালাম্মা বিকালে মাঠা বানানোর জন্য আসতেন। সময় হবার আগেই আম্মা সবকিছু প্রস্তুত রাখতেন, আর বলতেন, আফা আইবার আগে সবতা ঠিকঠাক করোরে, নাইলে মিজাজ খারাপ করিলবা! রান্না ঘরের বড় শেলফে দড়ি দিয়ে বাঁধা হতো বাশের ঘুটনি। আমরা বলতাম জুফরা। আগের রাতে পেতে রাখা দই মাটির মটকায় ঢেলে নিয়ে শুরু হতো ঘুটা। দড়ি দিয়ে দুর থেকে টানা হতো ঘুটনি। ঝপ-ঝপাৎ শব্দ হতো। খালাম্মার সারা শরীর অদ্ভুত ভঙ্গিতে প্যাঁচ খেতো। একেবারে রোজ নিয়ম করে তাঁর কোমর ধরে আমি লটকে যেতাম তখন। দুলতাম। খালাম্মা হারেরেরে বলে চিৎকার করতেন আর আম্মাকে ডাকতেন, কইগো টিফুর মা, দেখো কিতা করের। আম্মা দু ঘা দিয়ে সরিয়ে নিলে আমি আব্বার চেয়ারের হাতলে ধরে ভুউউউ বলে গাড়ী চালাতাম নয়তো লাকী আপার পাশে বসে গল্পের বই পড়া দেখতাম। ইচ্ছে হলে তখন সে শব্দ করে পড়তো। গতরাতে তার ছেলে মেসেঞ্জারে আমারে মুখ দিয়ে ভু ভু শোনালো!
অনেকক্ষণ কল চেপে চেপে পানি ফেলে যখন ঠান্ডা শীতল পানি বের হতো সেটা আনা হতো আম্মার জন্য। কাচের গ্লাসে সেই পানি রাখলে কুয়াশার মতো বাইরেটা জমে যেতো। আঁকিবুঁকি করার মতো। তখনও ফ্রিজ ছিলোনা আমাদের। মাঝে মাঝে বড়ুয়া মাসির বাসা থাকে বরফ আনা হতো। পরে উনাদের ছোট ফ্রিজটা আম্মা কিনে নিয়েছিলেন। দুধ চিনি মিশিয়ে আমরা আইসক্রিম বানাতাম সেটিতে।
আব্বার সম্ভবত একটা গোয়েন্দা ছিলো বাজারে, নয়তো আব্বা নিজেই ছিলেন একটা গোপন ফেলুদা। তাই দুপুর হবার মুখে একদম প্রথম তাওয়ার জিলাপি চলে আসতো বাড়িতে! আমার রোজা ভাঙানোর সেই বিরাট ষড়যন্ত্রে আম্মা ছিলেন তোপসে।
জুম্মার নামাজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম একবার। আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, সমস্যা কিতা? আমি বল্লাম, 'জিলাফি দেয়না! তুষা শিন্নিও দেয়না!' আব্বা জিলাপি আর এক টাকা বরাদ্দ করলেন পরের শুক্কুরবারে!
টাকার কৌটা নিয়ে আব্বা শাহজালালের মাজারে আসন গেড়ে বসে গেলেন। আমি ডানা ভাঙা জালালী কৈতর, শূন্যে উড়া দিয়ে এ কোন বিজনে চলে এলাম...

Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা