কয়েকছত্র প্রান্তিকপত্র

প্রান্তিক নিয়ে এতো লেখা হয়! ঘুরে ফিরে এই জায়গাটার কথা আসে। আসে স্বপনের চায়ের দোকানের কথা। সুনামগঞ্জের উদার হাওর আমার জীবনে যেমন জড়িয়ে আছে জননীর ওমের মতো, প্রান্তিকও বুঝি তেমনটাই!

বালক বয়েসে মেলায় যেতাম। কৈশোরে গেলাম নাটকের ঘরে। স্কুলঘরের মতো টিনের চালের ঘরটা কোন ফাঁকে এমন মায়ায় জড়ালো? কোন ফাঁকে মিশে গেলো এমন জীবনের গল্পে?

সেভাবে আমার সাথে প্রান্তিকের সম্পর্ক হওয়ার কথা ছিলো না। নিতান্তই এক কর্মী হিসাবে আমি সেখানে ছিলাম। কোনো গরম গরম ভাবনা ছিলো না মাথায়। দেশ সমাজ পাল্টে দেয়ার ধারণা নিয়ে সেখানে যাইনি। মঞ্চে উঠে কাঁপিয়ে দেবো, ফাটিয়ে দেবো তেমনটাও মাথায় ছিলো না। সম্ভবত জেনেটিক কারণে গিয়েছিলাম সেখানে! (এই জিন জিনিসটা কি???) বাপ এইসব করতেন বলে শুনেছি। ভাই আমার ঠিক আগে আগে সেখানে গিয়েছে।

এই জিন ভূত ছাড়া আর কি ছিলো তবে? সম্ভবত আড্ডা। সম্ভবত মানুষের টান।

প্রান্তিকের ভাঙা টিনের চালের নিচে এ নাটক করছে, তো ও করছে আবৃত্তি, আরেকজন হয়তো গান তুলছে গলায়... কী সরগরম সেখানে। তুমি যাও, মিশে যাও। মিশে যাও আনন্দ নগরে।

রাস্তার একদিকে মেডিকেল কলেজের হোস্টেল, আরেকদিকে প্রান্তিক। প্রথম-প্রথম হোস্টেলের সামনের দোকান থেকে চা আনতে হতো। নাট্যকর্মী হওয়ার কঠিনতম পরীক্ষা শুরু হতো এই চা এনে। ফ্লাস্ক হাতে নিতে নিতে অনেকদিন শুনতে হয়েছে, যাও, এখনতো ফ্লাস্ক পাচ্ছো, আমরা কেটলি দিয়ে রিকাবীবাজার থেকে চা আনতাম! তবে সেই পরীক্ষা বেশিদিন দিতে হয়নি। স্বপন একটা চা এর দোকান খুলে বসলো বারান্দায়। প্রান্তিক তার পূর্ণতা পেলো বুঝি এই চায়ের দোকানের মাঝ দিয়ে।

নাটকের ঘরে কী হত? কথাকলি শুধু নাটক করতো না। কবিতা, গান সবকিছুই ছিলো সেখানে পাঠ্য। আমি নিতান্তই বেসুরা মানুষ। বাপ কি সাধে অসুর বলে ডাকে? আমি বসে বসে সেইসব জিনিসপাতি দেখি। গানের দলে লোকজনের পেছনে বা কবিতার কোরাসে মাঝে মাঝে শেষ মানুষটা হয়ে বসে থাকি। এ এমনি এক বসে থাকা যে, না বসলেও কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না কারো। এই করে করে আধা যুগ পার করেছি হে...

আমি এ ঘরে যাই, ও ঘরে যাই। প্রান্তিকের উঠানে পাঠক ফোরাম পরে বন্ধুসভার আড্ডা হয়। সেখানে গিয়ে বসি। কেউ চা খেলে, পাশে বসে থাকলে এক কাপ জুটে যায়। এই করে করে বেশ ছিলাম।

প্রান্তিকে যাওয়ার আরেকটা কারণ হলো, পাকে চক্রে যে কয়টা বন্ধু জোগাড় হয়েছিলো (এইটাও একটা আজব ঘটনা, অন্তত আম্মার কাছে, আমার বন্ধু হতে পারে এটা তিনি এখনও সেভাবে বিশ্বাস করেন না) সবকটাই এখানে আসতো। এক ঢিলে আসলে অনেক পাখিই মারা হতো সেখানে। নাটক হলো, কবিতা হলো, আড্ডা হলো, বন্ধু হলো, গুল্লি হলো, মাল হলো, কুলখানি হলো... কতো কতো হলোরে!

প্রান্তিকে আমরা কেউ সাইকেল চালিয়ে যেতাম, কেউবা মোটর সাইকেল করে। কেউ যেতো রিক্সা চড়ে আর কেউ কেউ পায়ে চড়ে। রাতে বাড়ি ফিরতে গেলে এ তাকে ও একে দিয়ে আসতো বাড়িতে। পরিচিতরা কোন কারণে আমাদের দরকার পড়লে সোজা প্রান্তিকে চলে আসতেন। এমনকি একবার আমার মা, অসুস্থ মামাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার আগে সোজা চলে এসেছিলেন প্রান্তিকে। কথাকলির রুমে একটা ইম্প্রোভাইজেশনের কাজ চলছিলো। সেখানে কোরাস থেকে প্রশ্ন আসছে কেমন আছেন... কেমন আছেন... বাইরে থেকে উত্তর আসলে, তোমরা কেমন আছো জানি না, তোমাদের মা ভালো নাই!!! মামাকে ডাক্তার দেখানো থেকে হাসপাতাল সবকিছুই করা হলো, করে দিলো কথাকলি'র মানুষজন। আমাদের জননীরা এমনি নিশ্চিত থাকতেন প্রান্তিক নিয়ে, এমনি নির্ভরতা ছিলো কথাকলি নিয়ে। (এখনও আছে)। আবারো বলি বেশ ছিলাম আমরা।

গত মাসে একজন রক্ত দরকার বলে ফোন করলো। টুকুদাকে ফোন দিলাম আমি। মিনিট পনেরোতে ব্যবস্থা হয়ে গেলো। রক্তের এই ব্যাংকটা প্রান্তিক থেকেই গড়ে উঠেছে। বিষয়টা এমন পর্যায়ে ছিলো যে, অনেকেই জেনে গিয়েছিলো সেটা। রক্তের দরকার হলে সন্ধানীর কাছে না গিয়ে প্রান্তিকে হাজির হতো!

এইভাবে টুকরো টাকরা গল্প বলতে থাকলে বিশাল একটা কিছু দাঁড়িয়ে যাবে। সেটা করে লাভ কি? নাই, কোনো লাভ নাই। তাই একদিন হুট করে প্রান্তিক ভেঙে পড়ে, না ভেঙে পড়ে না, তারে চুরমার করে দেয়া হয়। ইঁট-কাঠের নির্মাণটা টুকরো টুকরো হয় আর সাথে আমাদের হৃদয়।

এই একটা ঘটনা সিলেটের সাংস্কৃতিক আন্দোলনরে কতটা নিয়ন্ত্রণ করেছে আর কতোটা পিছিয়ে দিয়েছে তার হিসাব দেয়ার ক্ষমতা আমার নাই। আমি শুধু আমারটাই জানি। আমি জানি এরপর থেকে রোজ বিকালে বসার একটা জায়গার জন্যে আমরা হন্যে হয়ে ঘুরেছি। নাটকের রিহার্সালের জন্যে একটা ছোট্ট খুপড়ি খুঁজতে খুঁজতে সিনিয়াররা ক্লান্ত হয়ে গেছেন। আমরা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়েছি, বিচ্ছিন্ন হয়েছি, একজন আরেকজনের কাছে শুধুই পরিচিত একজন হয়েছি...

আবার যখন ২০০৮ এ কথাকলি হাঁটি হাঁটি পা পা করে পুনর্যাত্রা করলো, তার আগে আমাদের অনেক কিছু বদলে গেছে। আমাদের কেউ এখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বড়কর্তা, কেউ বড় ব্যাংকার, শেয়ারের বাজারে কারো কারো দেদার ইনকাম, শহরের কেউকেটা ঠিকাদার সেও আমাদেরই ঘরের মানুষ। বিকাল চারটায় রিহার্সাল, তাই সবকিছু ফেলে রেখে, সে হোক চাকরি, দোকানদারী বা প্রেমিকার সাথে ডেটিং... সব ফেলে রেখে আসতে হতো। চারটার পরে ২/১ মিনিট দেরি হলেও রুমে ঢোকা যেতো না। কোনদিন ঢুকে পড়লেও চোরের মতো বসে থাকতে হতো। সেইসব দিন আর নাই। এখন রিহার্সালের সময় দিতে হলে আগে কথা বলে নিতে হয়। আমাদের কেউ যাই সাতটায়, কেউ যায় সাড়ে সাতে আর কেউবা আটটায়। তাও সেটা যে নিশ্চিতই হবে তাও নয়। পাঁচ মিনিট আগে কিংবা একেবারে না জানিয়েও এখন আমরা অনুপস্থিত থাকতে পারি! ডিরেক্টর বসে থাকেন, আমরা আসি না! জীবন আমাদের এমনই ভাড়ুয়া বানিয়েছে অথবা নাটক আমাদের আর সেভাবে বুঝি টানে না!

পায়লট এর আসল নাম কি? না কেউ বলতে পারবে না। প্রান্তিকের কোন মানুষই সেটা জানে বলে মনে হয় না। যে কথাকলির মেম্বার সে, তারাই জানে না! হ্যা পায়লটের নাম আমরা কেউ জানি না, তাকে সবাই পায়লট ডাকে। স্টেডিয়াম মর্কেটের একটা ফ্রিজের দোকানের ঠেলা চালাতো সে। বয়েসী মানুষ। মাঝে মাঝে তাকে দিয়ে সেট বা এটা সেটা টানানো হতো। এখনও আমার চোখে ভাসে, পায়লটকে টানা হ্যাচড়া করছে শিপন, অডিটোরিয়াম নিয়ে যাবার জন্যে। আগের রাতে নাটক হয়েছে। সেট পড়ে আছে, সেগুলো প্রান্তিকে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু পায়লট যাবে না। নাটকের মাল টেনে পয়সা বেশি পাওয়া যাবে না। রিতিমতো চিল্লা ফাল্লা করছে সে। স্টেডিয়ামের দিকে পেতে রাখা স্বপনের বেঞ্চে বসে বসে আমরা মজা দেখছি। ফোড়ন কাটছি, জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে শিপন আর পায়লট আরো চেতছে। সম্ভবত ঠেলা ড্রাইভার হিসাবে তাকে পাইলট বলে ডাকা হতো ঢং করে, পরে সেটা পায়লট হয়ে যায়। এই কাজটা প্রান্তিকেরই করা অসংখ্য পুঙগাম্যানশনের একটা। তো সেই পায়লট কোন ফাঁকে ফ্রিজের দোকান ছেড়ে কথাকলির রুমে ঢুকে গেলো সেটা আমি অন্তত খেয়াল করিনি। আমাদের বাড়িতে কিভাবে সে ঢুকেছে তাও খেয়াল করিনি কেউ। শহর থেকে ৮ কিলোর বেশি দুরের গ্রামে থাকা আমার বাড়ি অব্দি সে এসে পড়ে। আব্বা, আম্মা সবার সাথে তার প্রবল খাতির। নাটক করতে লন্ডন যাওয়ার মতো অসম্ভব স্বপ্নের কথাও সে আব্বার সাথে গল্প করে!

প্রান্তিক ভেঙ্গে গেলে, তারও পরে স্বপন শহর সিলেট থেকে গ্রামে চলে গেলে কিংবা মরে গেলেও সেভাবে আমরা চায়ের অভাব অনুভব করি না। কারণ পায়লট আমাদের সাথেই থাকে। এখন যারা নাটক করতে আসে তাদেরকে ঘর ঝাড় দেয়ার কথা বা চা আনতে বলার মতো অবস্থা আর নাই। তাছাড়া আমাদের স্থায়ী কোন বসারই যায়গা নাই। তাই এসব কাজের জন্যে আমাদের আছে পায়লট। সে জানে কে কোন পান খাবে, চায়ের রং জানে সে, জানে সিগারেটের ব্র্যান্ড।

রিহার্সাল থাকুক বা না থাকুক প্রান্তিকের রুমগুলো সরগরম থাকতো। এখন সেরকম কিছু নেই। আমার মতো একেবারেই একলা মানুষ যারা আছে দু একজন। যাদের শেষ পর্যন্ত কোন বন্ধুতাই আর টিকে থাকে না। তারা সন্ধ্যার আবছায়া মিলিয়ে গেলে জড়ো হই পংকী ভাইর দোকানে। সে দোকানের কয়েকটা চেয়ার আমরা দখল করে চা গিলি, পান চিবুই, সিগরেট টানি। আর মাঝে মাঝে রিহার্সাল থাকলে চেয়ে চিন্তে ভিক্ষে করে পাওয়া মদন মোহন কলেজ কিংবা স্টেডিয়ামের কোন রুমে বসে গেজাই।

মাঝখানে কিছুই ছিলো না। এখন একটা দুটো করে সংসার আবার জুড়ছে আমাদের। হারমোনিয়ামটা টিকে ছিলো। নতুন করে বানাতে হয়েছে নাল, ঢোল আর একেবারেই নতুন যোগ হলো নাকাড়া। কর্তাল, মন্দিরাও জোগাড় হয়েছে। সবকিছু টানা হ্যাচড়া করে আমরা একবার যাই মদনে, তো আরেকবার যাই স্টেডিয়ামে। দু যায়গাই যখন হাতছাড়া হয়, তখন পায়লট সেসব নিয়ে যায় লিটন ভাইর বাসায়, আর আমরা আবার আসর পাতি পংকী ভাইর দোকানে। রিকাবী বাজার পয়েন্টে আবার হৈ হৈ জমে উঠে। যে আমরা চেয়ে চিন্তে চায়ের বিল জোগাড় করতাম, সেই আমরাই এরে তারে চা গিলাই। আর বিল দেয়ার সময় অবাক হয়ে দেখি আমাদের মাঝে সবচে ছোট যেজন, নয়ন (কলেজে সবে ভর্তি হয়েছে), সে বিলটা আগেই দিয়ে দিয়েছে!!!

কথাকলি কিংবা প্রান্তিকের রুমে ম্যাট বিছানো থাকতো। সেখানে ছড়িয়ে বসে, শুয়ে আমরা তাল ঠুকতাম আর অন্য কেউ একজন ধরতো গান। এখন সেটা হয় না। আমরা চেয়ারে সাহেব হয়ে বসি। আমাদের নরোম কাপড়ের দামি প্যান্ট যাতে নষ্ট না হয়, জুতোর পালিশটা যাতে ঠিক থাকে সেটা সবসময় খেয়াল রাখি। শামীম ভাই মুড ভালো থাকলে গান ধরে। চেয়ারে বসে বসে আমরা মাথা দুলাই, মাঝে মাঝে গলা মিলাই। মোবাইল ফোনে কথা বলি, এস এম এস পড়ি... আমাদের বিন্যস্ত করে কাটা চুল, আমাদের পরিপাটি শার্ট, তার কলারের নিচে বাঁধা টাই...। মাথা দুলাই তবু আর সেই ভাব আসে না।

প্রিয় প্রান্তিক, আমরা আর ভালো থাকি না সম্ভবত...


Comments

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা