বাড়ি ফেরা



আজ গরম খুব বেশি। শ্রাবণ মাসের তপ্ত রোদ। এই মাসটা বৃষ্টির মাস। বৃষ্টি মানেই একটা কোমল ভাবনা, কোমল সময়। রবীন্দ্রনাথ বৃষ্টি নিয়ে কতো রকম আমোদে কাব্য রচনা করেছেন। কিন্তু সব কিছুই এখন উল্টে গেছে। গত তিনদিন ধরে টানা রোদ দিচ্ছে। আকাশে একফোটা মেঘ নেই। এরকম রোদ আরো কয়েকদিন হয়তো চলবে। অবশ্য এই মাসটার কোন তাল নেই। কোন ফাকে দেখা যাবে কোত্থেকে টেনে হিচড়ে মেঘ নিয়ে এসেছে, তারপর ঝুম...

রাহাত চিন্তা করে দেখেছে, প্রকৃতি সবসময় তার সাথে বৈরি আচরণ করে। যখন একটু ছায়া দরকার তার, তখন দেখা যাবে আকাশে এক টুকরা মেঘও নেই। আর যখন তার রোদ দরকার তখন দেখা যাবে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। তিন রাস্তার মোড়টাতে দাড়িয়ে রিকশা খুজতে খুজতে ঘামে প্রায় গোসল হয়ে যাচ্ছে তার। না পাচ্ছে রিক্সা না পাচ্ছে ছায়া।

ফোন বাজে প্যান্টের পকেটে। ময়নাবাবু নিশ্চয়। হ্যা, দাদুর ফোন থেকে রিং করেছে। ইদানিং এই এক মজা হয়েছে তার। বাবার নাম্বারটা মুখস্থ করেছে। তাই যখন ইচ্ছে তখন যারতার ফোন থেকে কল করে ফেলে। সেদিন স্কুল থেকে ফোন দিয়েছে। ক্লাস টিচারের ফোন থেকে। বিষয়টা ভাবতেই বিব্রত হতে হয়। আজকে এই নিয়ে তিনবার হলো। ফোন ধরেই এক কথা, বাবা ফুলঝরি বাতি কিনছো? হ্যা, হ্যা বলেও পার পাওয়া যাচ্ছে না। নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে বলছে, আনবে কিন্তু, আনবে কিন্তু। এখন ফুলঝরি বাতির সাথে যোগ হয়েছে এক প্যাকেট আগর বাতি। এটা দাদুর জন্যে। রাহাত হাসে। মা নিশ্চয় পাশে থেকে ইশারা দিয়ে বলে দিচ্ছে। আজকে শবে বরাত। মা সন্ধ্যার পর থেকেই এবাদতে বসবে। তাই আগর বাতির অর্ডার। ফোন রেখে আবার দোকানে ফিরে যায় রাহাত।

পলিথিনের ছোট্ট ব্যাগটাতে এখন এক প্যাকেট আগরবাতি, এক প্যাকেট মশার কয়েল আর এক প্যাকেট ফুলঝরি বাতি।

ছোট বেলায় এমন দিনে বাবা তাদের জন্যে ফুলঝরি বাতি নিয়ে আসতেন। লাইন ধরে তারা ভাইবোন মিলে ফুলঝরির বাতি ধরিয়ে আকাশে ছুড়ে দিতো। কারটা কত উপরে উঠে আর কত বেশি জ্বলে সেই প্রতিযোগীতা চলতো। মায়ের ছিলো প্রবল আগ্রহ। ছেলে মেয়ের সাথে তিনিও থাকতেন। রাহাতের সেইসব আগ্রহ এখন মরে গেছে, কিন্তু মা আগের মতোই আছেন। আজ সন্ধ্যায় এবাদতের ফাঁকে ঠিকই নাতির সাথে ফুলঝুরির বাতি জ্বালবেন তিনি।

রিক্সা পেতে হলে রাস্তাটা পাড়ি দিতে হবে। রাহাত দু পাশ দেখে রাস্তা পাড়ি দেয়। টেলিফোনের থামটার পাশে দাড়িয়ে রিক্সা ডাকতে থাকে। না, রিক্সা নেই। যাও দু’একটা খালি আসছে তারা কেউই যেতে চায় না।

ঠিক তখনই রাহাতকে অবাক করে দিয়ে আস্তে আস্তে আবছায়া করতে থাকে। আকাশে তাকিয়ে দেখে কয়েক টুকরো মেঘ জমছে তার মাথার উপর। রাহাত হাসে, আস্তে আস্তে মেঘ জমতে থাকে। আবাছায়াটা কালো হতে হতে একসময় ঝুপ করে নেমে আসে বৃষ্টি।


কোনমতে বাঁচানো গেছে হাতের প্যাকেটটা। পলিথিনটার মুখে শক্ত করে গিট্টু দিয়ে পানি আটকানো গেলো। কিন্তু শরীরটা আর বাঁচানো গেলো না। অবশ্য রাহাত চেষ্টাও করেনি। ভিজতে তার ভালই লাগছিলো। টানা তিনদিনের প্রচন্ড গরম শেষে এই বৃষ্টি। পাশের দোকান থেকে আরেকটা পলিথিনের ব্যাগ চেয়ে নিয়ে সেটাতে মানিব্যাগ আর মোবাইল পুরে রাহাত হাটতে থাকে রাস্তায়। লোকজন তাকে অবাক চোখে দেখে, সেদিকে খেয়াল নেই তার। সে হাটছে। এখন আর রিক্সার অপেক্ষা করে লাভ নেই। ড্রাইভারগুলো এখন যেকোন দোকানের সামনে রিক্সা দাড় করিয়ে বৃষ্টি থেকে বাঁচার চেষ্টা করবে।

রাহাত হাটতে হাটতে ময়নাবাবুর কথা ভাবে। আজ ফুলঝরি নিয়ে কি ধুন্দুমার হবে। ছোটখাটো বিষয় থেকেও মায়নাবাবু আনন্দ খুঁজে পায়। তার অপার বিস্ময় পৃথিবীর সকল কিছুতেই। মা নিশ্চয় এই তারাবাতির কথা বলেছে। আর সেই থেকেই বায়না, তাকে কিনে দিতে হবে। এম্নিতে সে তেমন বায়না ধরা টাইপ বাচ্চা নয়। বড় কোন চাহিদা ওর নেই। দোকানে গিয়ে কোন কিছুর জন্যে জেদ ধরাও ওর মধ্যে নেই। তবু মাঝে মাঝে এমন কিছুর জন্যে হামলে পড়ে। রাহাতের এতে খারাপ লাগে না। ভালই লাগে। হাতে যখন পছন্দের জিনিসটা পাবে তখন ফোঁকলা দাত বের করে যে হাসিটা দেবে আর গলা জড়িয়ে ধরে যখন আদর করবে তখন পুরোটা দুনিয়া প্যাকেট করে ওকে দিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।

রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। প্রায় সব রাস্তাই ভেঙ্গে একসার। রাস্তার মাঝখানে ইয়া বড় বড় গর্ত। একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়। একেকটা যেনো ছোটখাটো পুকুর। সেইসব পুকুর থেকে বাঁচতে গাড়িগুলো ফুটপাতে উঠে আসে। রাহাত হাটছে আর সেইসব পাশকাটানো গাড়ি তাকে পেছনে ফেলে যাচ্ছে। বৃষ্টির মাঝে তাদের গতি যেনো বেড়ে গেছে। আশেপশের কোন কিছুকেই  আমলে আনছে না। চাকায় লেগে পানির ঝাপটা এসে কয়েকবার পড়েছে রাহাতের গায়ে। সাথে সাথেই সেই ময়লা ধুয়ে নিয়েছে বৃষ্টি। তাই রাগ করতে গিয়েও রাগ করেনি সে। বরং ছেলের কথা ভাবতে ভাবতে আনমনে হাটছিলো। বৃষ্টি হওয়াতে ভালই হলো। আজ হাটতে হাটতেই বাড়ি যাওয়া যাবে। এমনিতে রাস্তাটা খুব লম্বা নয়, তবু হাটা হয় না কখনও।

প্রায় পৌছে যাবার আগে, বড় রাস্তার শেষ মোড়টাতে এসে দাড়ায় রাহাত। এখন রাস্তা পাড়ি দিতে হবে। এরপর একটু এগিয়ে বায়ে ঢুকে পড়তে হবে তাদের গলিতে। মাত্র পাচটা বাড়ি তারপরই ময়নাবাবু। বুয়া দরজা খুলে দিলে দেখা যাবে সামনে দাড়িয়ে আছে ফোঁকলা দাত নিয়ে। হামি দেবার নাম নেই, প্রথমেই হাত পেতে তার জিনিস চাইবে। আজ অবশ্য অন্যরকমও হতে পারে। ভিজে জুবোথুবো বাপকে দেখে কিছুটা অবাক হতে পারে সে। কিংবা নিজেও বৃষ্টিতে ভিজবে বলে লাফ দিয়ে বাবার কোলে উঠে যেতে পারে। রাহাত কল্পনায় ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে, ঘুরতে থাকে, ময়নাবাবু দু-হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে দেয়, রাহাতও আকাশ দেখে, দরজায় দাড়ানো মা চিৎকার করে বলেন, রাহাত না... না... ভিজিস না, ওর জ্বর আসবে... না... না... না... অনেক কণ্ঠে সেই না শুনতে পায় রাহাত, শুনতে পায় তীব্র ব্রেক কষার ধাতব শব্দ, মাঝ রাস্তায় জমে থাকা এক ঝাপটা পানি এসে পড়ে তার চোখে মুখে, হাত থেকে ছিটকে পড়ে পলিথিনের জড়ানো ব্যাগ... রক্তে মাখা মাখি হতে হতে রাহাতের শুধু মনে পড়ে, ব্যাগটা ছিড়ে গেলে ফুলঝরি বাতিগুলো পানিতে নেতিয়ে যাবে, আর জ্বলবে না। সে ছুটে গিয়ে প্যাকেটটা তুলে আনতে চায়, পারে না।



আগস্ট, ২০১০

Comments

  1. কে হায় হৃদয় খুঁড়ে...

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ শিমুল মাস্টাসসাব

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

মিহিদানা