আমাদেরও ছিল সুসময়

এই লেখাটা মানসম্মত নয়। অবিন্যাস্ত এবং অসম্পূর্ণ। অনেক কথা, অনেকের কথা বলার ছিল, বলা হল না। আসলে এখন আর আগের মত বলতে পারিনা, যতটা কথা আছে বুকের ভেতর। তাই প্রথমেই দুঃখপ্রকাশ, মা প্রার্থনা করজোড়।


২৩ নভেম্বর ১৯৯৭। শীতের সন্ধ্যা। সিলেট শহরের সবচেয়ে কাছের একটি গ্রাম। প্রায় নিঃসঙ্গ তরুণ বসে আছে লন্ঠনের আলোয়। কিছুটা বিষন্ন। প্রায়ান্ধকার সেই সময়ে তালপাতার সেপাই এর কন্ঠ। বারান্দায় বেরিয়ে আসে বিষন্ন তরুণ। অন্ধকারে দাঁড়ানো অবয়ব দেখে বিস্ময়ে প্রশ্ন করে তুমি! উত্তরে বলা হয়_'শুভ জন্মদিন'। বিষন্নতা কেটে যায়। মন ভালো হওয়া কান্না গলায় দলা পাকায়। বোকা বোকা আবেগ নিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণ বলে কীরে আমাকে ঘরে যেতে দে। ঠান্ডা লাগছে। সেদিনের সেই বিষন্ন তরুণ হলাম আমি আর বোকার মত ভালবাসা ধারণ করা লম্বা লোকটার নাম রিপন চৌধুরী। সেবারের সেই জন্মদিনে এই একজনই আমাকে শুভ কামনা জানিয়েছিল। আর শুভেচ্ছা জানাতে রিপন দা প্রায় চার কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে গিয়েছিল। চার কিলোমিটার সাইকেল চালানো অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সাইকেলটিতে কোনোদিন তেল-গ্রিজ যদি না দেওয়া হয়? সাইকেল চালিয়ে রিপন দা ঘেমে নেয়ে গিয়েছিল। এমনই ছিল আমাদের বন্ধন। এমনি জড়াজড়ি করে বেড়ে উঠেছি আমরা ক'জন তরুণ-তরুণী। একই শহরে একই সময়ে প্রায় একই রকম স্বপ্ন নিয়ে আমরা বেঁচেছিলাম অনেকদিন। হঁ্যা ছিলাম। এখন আর নেই। ছিটকে পড়েছি। সময় এবং স্বপ্ন থেকে।আমরা একাট্টা হয়েছিলাম কবে? সম্ভবত ১৯৯৬ এর শেষ অথবা ১৯৯৭ সালের প্রথম দিকে। দশ বছর। এই সময়ের মধ্যেই আমরা সাধারণ থেকে স্বপ্নবাজ হয়েছি। তবে স্বপ্নবাজ থেকে আর সাধারণে ফিরে যেতে পারিনি। অন্য কেমন এক অসামাজিক জীবে পরিণত হয়েছি। তাই প্রিয় রিপন দা'র বিয়েতে যেতে পারেনা অপু। 'রাজাকার অপুর' ছেলেকে দেখতে যায়না রিয়াদ।আজ কোন্ গল্প লিখব? আমাদের সেই সময়ের কথা, যেসময় ছিল বড় বেশি সুসময়। না এই আজকের কথা, যখন বিষন্ন বিচ্ছিন্ন জীবনই রোজনামচার শেষ কথা।সকাল, সে সকাল শুরু হত কখন! দশ না এগার। শুধু মনে আছে দিনের সূচির শুরুটা হতে হবে রামকৃষ্ণ মিশন থেকে। গৌরিশ ছিল সেখানে। তারপর... বর্ণনা নেই। সেসব সময়ের কোনো বর্ণনা দেওয়া যায়না। [আলুরতল, কানিশাইল, সুরমা নদী, রাজু, রানা, চেরী....।] শুধু এই বলা যায়, প্রতিদিন দেখা হতে হবে বিনয় দা'র সাথে, চলন্তিকায়। উজ্জ্বল দা মিউনিসিপ্যাল মার্কেটের চারতলা। রিপন দা টেকনিক্যাল রোড কিংবা ব্রহ্মময়ী বাজারে। রিয়াদকে পাওয়া যেত কলেজে। রিয়াদ মনে আছে 'ফিফ্টি সিসি' ভ্রমণ? ওই মেয়েটার নাম কী ছিল রিয়াদ? রোজ সকাল 11টায় এমসি কলেজের কমনরুম থেকে বেরিয়ে কেমিস্ট্রি পর্যন্ত ছিল সরল গতিপথ। দিঘিরপারে তুই। কোনোদিন কথা বলা হলনা! শহীদ মিনারে ছিল প্রথম নিবাস। শুক্রবারের বিকাল। আমরা সবাই, বিনয় দা'র নাড়ু, হিমেল দা'র জিলেপি, মদের বোতলে গৌরিশের মদরঙ জল... অর্না এল সেখানে। তার আগে শাম্মি, পরে রানা। স্থান বদল, প্রান্তিক চত্বর। বাপ্পার মাথায় কমিটির চিন্তা। ম্যাগাজিন, কবিতা, ফিচার, ছোটগল্প, দেশময় ছড়িয়ে পড়ে কথার মায়া। আসলেই সে সময় ছিল বড় বেশি সুসময়। আরিফ জেবতিক, হাসান মোরশেদ, ( এই দুজনই আবার আমার ব্যক্তিক সম্পর্কের মোড়কে বাধা। তাই এখনও টিকে আছে সম্পর্কের চিকন সুতা।) মনি, আমাদের সেই মানুষটা নিলাঞ্জন দাশ টুকু, টুকু দা। কোন ফাঁকে এসে জুটেছিল মোনা, সুমি, চেরী, জাকির, রাজু। শুরু থেকেই ছিল সাইফ সেলিম। আমাদের স্বপ্নের সঙ্গি হল নীলু, দিপক... কোথায় সবাই এখন, কোথায়? একটু আওয়াজ দাও, আমার এখন বড় একা লাগে। বড় একা। একা হলেই আমি ভয় পাই।কী এক নির্বাচন হল একবার বন্ধুসভায়। বড় লজ্জায় পড়লাম আমি। সেই নির্বাচনে বিজয়ীদের তালিকায় যে আমিও আছি। আমি লজ্জা পেলে কী হবে বন্ধুরা যে রাজ্য পেল! ট্রেনের কামরা রিজার্ভ করে চল, চল, ঢাকা চল। চন্দন দা'র ভিডিও ক্যামেরাটা কোথায় গেল এখন? সেই ক্যাসেটটা কী আছে? রিপন'দা 'হা' মেলে ঘুমিয়েছিল ট্রেনে। মান্নান'দা পানির বোতলের মধ্যে কী যেন একটা পাগলা পানি টাইপের নিয়ে এসেছিল। মোরশেদ তখন ভদ্র। টুকু দা যে সাথে! ট্রেনের কামরায় যত মানুষ ছিল তারা কী কোনোদিন ভুলতে পারবে রাতজাগা প্রাণোচ্ছল একদল পাগল তরুণের কথা। সেবার আমাকে ঢাকায় থাকতে হয়েছিল। বন্ধুদের ধারণা হল আমি বুঝি আর সিলেটে ফিরবো না। ঢাকায় থেকে যাবো। টুকু'দাকে কোনো এক ফাঁকে সেটা তারা জানিয়েও দিল। ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার আগ মুহূর্তে টুকু'দা হাত চেপে ধরে বল্লেন, কোনোমতেই ঢাকায় থাকবি না। কাজ শেষ হলেই সোজা চলে আসবি। টুকু'দা আমি এখনও সিলেটেই আছি। কেন কীভাবে সেটাওতো আপনার জানা। আমাদের ছিল কত আয়োজন। সুনামগঞ্জে এসিড সন্ত্রাস হল। আমাদের সবচেয়ে মোটাজন চন্দন'দা, আর সবচেয়ে ছোটজন আমি অপু। মেয়েটিকে নিয়ে ঢাকায় গেলাম। সাদা একটা কাগজে এক গাদা টেলিফোন নাম্বার লিখে বুক পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন চন্দন দা। যদি হারিয়ে যাই তখন কাজে লাগবে। কতদিন সেই কাগজটা আমি যত্নে রেখে দিয়েছিলা। কতটা আদরে আমাকে আগলে রাখত অর্না। এখনও আমি রয়েছি সেই আগের মত ওর কাছে। ঢাকায় গেলে মান্না'দা যেন হাতে চাঁদ পায়। সাথে নিয়ে ঘুরে এখানে সেখানে। আর একটু পরপর অর্নার ফোন_'তুই এখন কই?' রাতে মশারি টানিয়ে বলে যায়, সকালে উঠার দরকার নেই। ১২টার বাস ধরবি। আমার চোখে পানি চলে আসে। আসলেইরে অর্না অনেকদিন ধরে ঘুম হয়না। ১০টার তাড়ায় ৯টায় ঘুম ভাঙে। আবার মেরুদন্ড সোজা করতে করতে রাত ৩টা।উজ্জ্বল'দা, রিপন'দা এখনও সেই আগের মতই অভিমানভরা কন্ঠে বলে_তুই আর আগের মত নাই। মুখে বড় বড় কথা বলে ওদেরকে উড়িয়ে দিলেও ভেতরে ভেতরে আমি কতটা বদলে গেছি সেতো জানি শুধুই আমি।উজ্জ্বল'দা, আমি এখন ছেলের বাপ, সময় আমাকে শুষে নিয়ে ছ্যাবড়া বানিয়ে ফেলছে। আমি শুধু পিষ্ট হই সময়ের। শুক্রবারের বিকেলটায় এখনও বুকের বামপাশে কেমন যেন করে। কিন্তু আমাকে ছুটতে হয় অন্য আঙ্গিনায়। আমি আর আমার আঙ্গিনায় দেবু-রাসেলদের মত প্রাণ খুলে কথা বলতে পারি না। উসখুস করি, ঘড়ি দেখি, মোবাইল বাজে। নিজেকে বেমানান মনে হয়।তবুও হঠাৎ কোন এক আবেগী কন্ঠ চিৎকার করে পেছন থেকে ডাক দেয় অপু। শব্দেরা কানে ঢুকেই জানান দেয় এ তোমার আলগা হয়ে যাওয়া কিশোর বেলার সপ্নসঙ্গি। আমি আপ্লুত হই...

Comments

  1. নজমুল আলবাব,
    এই লেখাটা পড়া যাচ্ছেনা ।
    গোল্লা গোল্লা হয়ে গেছে ।

    শুধু এই লেখাটা, বাকিগুলো ঠিক আছে।

    আবার পোস্ট করে দেখতে পারেন।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

বিহঙ্গ হয়েছে অন্ধ, বন্ধ করেছে পাখা

ম্লান আলোয় দেখা টুকরো শৈশব ০২

বিকেলের রোদে দেখা মেয়ে